আষাঢ়ে গল্প
আমার হলিউড অভিযান
‘দ্য রেভেন্যান্ট’ ছবিটি অস্কার পাওয়ায় প্রথমে একটু চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। আমাদের দেশে ছোটখাটো পুরস্কার পেলেই নির্মাতারা সেলিব্রেটি বনে যান। বন্ধু, সহকর্মীদের সঙ্গে কথাবার্তায় থাকেন খুব সাবধানী। ব্যক্তিত্ব কমে যাওয়ার ভয়ে ইয়ার্কির কাতারে পড়ে এমন শব্দ ভুলেও উচ্চারণ করেন না। সেখানে অস্কারের মতো পুরস্কার ‘দ্য রেভেন্যান্ট’ ছবির পরিচালক ‘আলেহান্দ্রো গঞ্জালেস’কে কতটা পাল্টে দেবে, সেটা ভেবেই এই দুশ্চিন্তা।
অস্কার পাওয়ার সপ্তাহখানেক পর গঞ্জালেসের মেইল পেলাম। রিপ্লাই দিতে দেরি হওয়ায় সরি-টরি বলে একাকার করে ফেলেছে। এত দিন হুমায়ূন আহমেদ, জাফর ইকবাল স্যারদের আত্মজীবনীতে ভিনদেশিদের বিনয়ের কথা জেনেছি। আজ সৌভাগ্য হলো নিজ চোখে দেখার।
‘আমার লেখা সিনেমার গল্পটা তার খুবই পছন্দ হয়েছে। প্রযোজকের সঙ্গে কথা বলেছেন। সায়েন্স ফিকশন গল্পটা প্রযোজককেও মুগ্ধ করেছে। সঠিকভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারলে আরেকটা অস্কারের সম্ভাবনা প্রবল।’ মেইল পড়ছি আর দরদর করে ঘামছি।
নিজেকে ভাগ্যহতদের কাতারে ভাবতাম এত দিন। আমার মতই দুর্ভাগা এক তরুণ রাতে স্বপ্ন দেখছিল। হঠাৎ সেই স্বপ্ন মাঝপথে ভেঙে যায়। ছেলেটা জেগে উঠলেও তার স্বপ্ন জাগে না। স্বপ্ন চলতেই থাকে। ছেলেটা একই সঙ্গে স্বপ্ন ও বাস্তবে ঘুরতে শুরু করে। সে বাস্তব; যা ঘটছে স্বপ্ন। এমন অবস্থায় ভয়ংকর এক কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলে তরুণ। সেই ভয়ংকর ঘটনা নিয়ে এগিয়েছে আমার চলচ্চিত্রের গল্প। এ দেশের বড় বড় কয়েকজন পরিচালককে দেখিয়েছিলাম। একজন গল্প পড়ে মুখের ওপর ছুড়ে মেরেছিল। একজন তো বলেই বসলেন, ‘আমি মানছি গাঁজা উপকারী, তবে তা নির্দিষ্ট মাত্রায়। আপনি তো মাত্রাছাড়া গাঁজা খান। এত এত গাঁজা খেলে মারা পড়বেন।’
এক বন্ধুর পরামর্শে হেয়ালি করে গল্পটির ইংরেজি অনুবাদ করে নিই সাকিব ভাইকে দিয়ে। সাকিব ভাই ইংরেজির টাইটানিক (বড় জাহাজ)। অনেক কষ্টে পরিচালক আলেহান্দ্রো গঞ্জালেসের মেইল অ্যাড্রেস জোগাড় করি। তার পর সবকিছু স্বপ্নের মতো ঘটতে থাকে। মেইল করার দুদিনের মাথায় রিপ্লাই, এর পর অনেক অনেক কথা। স্ক্রিপ্ট আমি লিখব, না তারা লিখবে। শুধু গল্পের জন্য কত ডলার চাই। আমার পছন্দের কোনো অভিনয়শিল্পীকে নিতে চাই কি না? তরুণ ছেলেটার জায়গায় আমি অভিনয় করতে চাই কি না, ব্লা ব্লা ব্লা।
যুক্তরাষ্ট্রের তথ্য মন্ত্রণালয়ের একটা চিঠির সঙ্গে ১০ হাজার ইউএস ডলার হাতে পেয়ে যতটা আনন্দিত হয়েছি, ততটা প্রকাশ করিনি। সাকিব ভাই বলেছেন, ‘এরা তোমাকে টাকা দিয়ে গল্প ক্রেডিট না দেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। তুমি মেইলের স্ক্রিনশট রেখে দাও। দেখনি, স্যার জগদীশচন্দ্র বসুর সঙ্গে কী করেছিল?’ আমি সব ডকুমেন্টের স্ক্রিনশট রেখে দিলাম।
প্রথমবারের মতো দেশের বাইরে গিয়েছিলাম ইন্ডিয়ায়। ইন্ডিয়া আবার বিদেশ হয় নাকি? বাসে চড়ে যাওয়া যায়। তাই এটাই আমার প্রথম বিদেশ সফর। আমেরিকা! বিমান থেকে নামতেই ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার দমকা হাওয়া জাপটে ধরল। আমন্ত্রণপত্র দেখানোয় চেকিংয়ের ঝামেলা থেকে সহজেই মুক্তি পেলাম।
বিমানবালাদের মতো সুন্দরী দুই তরুণীর কাণ্ড দেখে কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে গেলাম। তারা দুজন মি. আসাদ লেখা প্ল্যাকার্ড ধরে দাঁড়িয়ে আছে । এত দিন ‘তাসকিন মেরি মি’ লেখা প্ল্যাকার্ড দেখেছি। আজ মনে হচ্ছে ওরা ‘আসাদ মেরি মি’ লিখে দাঁড়িয়ে আছে। এগিয়ে গিয়ে নাম বললাম। হ্যান্ডশেক করল। হাগ করল। আল্লাহ গো... আরো কী না কী যেন বাদ আছে।
মেয়ে দুইটা আমাকে হোটেলে নিয়ে গেল। সাদা চামড়ার দুই সুন্দরী আমাকে খাতির করছে ভাবতেই দেশে মলি, পলিদের কথা মনে পড়ে গেল। কত ঘুরেছি ওদের পিছে, পাত্তাই দেয়নি।
লম্বা বিমান জার্নির ধকল কাটাতে গোসল সেরে খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লাম। পরদিন গাড়ি এসে আমাকে নিয়ে গেল সোজা হলিউডে। এতকাল যা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি, আজ তা চোখের সামনে দেখছি। গাড়ি যেতে যেতে দেখি ‘লাইফ অব পাই’-এর ডিরেক্টর অ্যাং লি জনি ডেপকে একটা অ্যাকশন দৃশ্য বুঝিয়ে দিচ্ছে।
আলেহান্দ্রো আমাকে দেখে পাগল হয়ে গেল। বাবরিওয়ালা দৌড়ে এসে আলিঙ্গন করল। এ রকম জড়াজড়িতে অভ্যস্ত নই, তবু সামলে নিলাম উপস্থিত বুদ্ধির জোরে। আমার জন্য একজন বাঙালিকে রাখা হয়েছে। তার দায়িত্ব হলো আমার সবকিছু দেখভাল করা। ছেলেটার বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ। নিউইয়র্ক ভার্সিটিতে পড়ে। এই জবটা পার্টটাইম।
বেশ কয়েকটা চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করলাম। বাংলা ও ইংরেজিতে তৈরি করা হয়েছে সব দলিল। একই প্রযোজক ও পরিচালক টানা তিনটা ছবি করবেন আমার গল্প দিয়ে। এই গল্পের তিনটা সিক্যুয়াল হবে। আমি চাইলে সহকারী পরিচালক হিসেবেও থাকতে পারব। তার জন্য এক্সট্রা পে করবে। মুর্শিদাবাদের ছেলেটা আমাকে বলল রাজি হয়ে যেতে। ‘স্যার, ওদের সঙ্গে থাকলে আপনি কিছু শিখতে পারবেন। পরে দেশে গিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রকে পাল্টে দিতে পারবেন।’ আমি রাজি হয়ে চোখ বুজে শুধু স্বাক্ষর করে গেলাম।
আমার অ্যাকাউন্টে ১০ মিলিয়ন ডলার জমা হয়ে গেছে। এই মাত্র মোবাইলে নোটিফিকেশন আসছে। মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে কপর্দকহীন আসাদ হয়ে গেল মিলিওনেয়ার। ওদের থেকে বিদায় নিলাম। রাস্তায় নেমে ড্রাইভারকে বললাম, ‘তুমি এগোতে থাকো, আমি আসছি।’
ড্রাইভারের চোখ হাঁ হয়ে গেল। আমার মতো গ্রেট রাস্তায় হাঁটবে, তা সে মানতে পারছে না। তাকে বললাম, ‘ব্যাটা, আমাদের দেশে লাখ লাখ গ্রেট ফুটপাতে লেবুর শরবত বিক্রি করে।’
নিউইয়র্কের আকাশ ঝকঝকে নীল হবে ভেবেছিলাম। কেমন ফ্যাকাসে লাগছে। আকাশ ভরা গুমোট মেঘ। হয়তো এশিয়ার বাংলাদেশ থেকে ক্ষুদ্র এক ছেলে এসে তাদের বাজার দখল করছে, এটা মানতে পারছে না। কেমন শীত শীত করছে। মনে হয় বৃষ্টি হবে। বৃষ্টি হলে ভালো। আজ দুই হাত প্রসারিত করে ভিজব। নিউইয়র্কবাসী দেখুক, কেমন করে ভিজতে হয়।
গ্রাম থেকে বন্ধু ইমরান মেসেজ দিয়েছে। ইমরান একটা ভেজা কদম ফুলের ছবি দিয়ে নিচে লিখেছে :
“কদমের থেকে শিখিয়া নিও
প্রাণ খুলিয়া হাসার,
বৃষ্টি হোক আর নাই হোক
আজ পয়লা আষাঢ়।”
বজ্রপাতের বিকট শব্দে আকাশের দিকে তাকালাম। কালো মেঘের দল নিচে নেমে আসছে। এক্ষুনি বৃষ্টি হবে। তবে কি আমেরিকাতেও আষাঢ় মাস বলে কিছু আছে? তারাও কি আসর জমায় আষাঢ়ে গল্পের?