ঢাকার কথা ৪৬
বারভুঁইয়াদের যুগে ঢাকা
মোগল সুবাদারদের লক্ষ্য ছিল শীতলক্ষ্যা নদীতে অবস্থিত বারাভুঁইয়াদের শেষ নৌঘাঁটি ধ্বংস করে পূর্ব বাংলায় মোগল আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। নারায়ণগঞ্জের কাছে শীতলক্ষ্যা নদীতে আক্রমণ পরিচালনার জন্য কাছাকাছি কোনো অঞ্চলে সুবাদারের শিবির স্থাপন করা ছিল জরুরি। এ কারণেই সুবাদার ইসলাম খাঁ ঢাকাকে বেছে নেন। মোগল আগমন-পূর্ব সময় থেকে ঢাকায় একটি নাগরিক জীবন প্রতিষ্ঠিত থাকায় সুবাদার ঢাকাকে নির্বাচন করেন। শিবির স্থাপনের জন্য কৌশলগত দিক থেকে শীতলক্ষ্যা নদীতে নৌ আক্রমণের জন্য উপযুক্ত বিবেচনা করা হয়েছিল ঢাকাকে। সাধারণত মোগল বহরের আঙ্গিক খুব বিশাল হয়ে থাকে। সুবাদার, সভাসদ, সৈন্যবাহিনী, নানা পদবির কর্মচারী, লটবহর, অস্ত্রশস্ত্র, হাতি, ঘোড়া ইত্যাদি থাকে মোগল বহরে। এসব কারণে নাগরিক সুবিধা সম্পন্ন এলাকাকে গুরুত্ব দেওয়া হয় শিবির স্থাপনে।
সুবাদার ইসলাম খান ঢাকায় প্রবেশের আগেই ঢাকা সম্পর্কে অবহিত হয়েছিলেন । ‘বাহারিস্তান-ই-গাইবি’ গ্রন্থে মির্জা নাথান উল্লেখ করেন মোগল বহর থেকে উত্তর বাংলার পথে অগ্রসর হয়েছিলেন। পথিমধ্যে বগুড়ার শেরপুর মোর্চাতে যাত্রা বিরতি করেন। এখান থেকে তাঁর নৌবহর সুসংগঠিত করে ঢাকার দিকে অগ্রসর হন। ইসলাম খাঁর নেতৃত্বে নৌ ও গোলন্দাজ বাহিনী ইছামতি নদী দিয়ে এগিয়ে চলে। বিশাল পরিকল্পনায় সাজানো নৌবহর দেখে অনুমান করা যায় ঢাকায় তখন বারভুঁইয়াদের শক্ত ঘাঁটি ছিল। এই শহরকে অধিকার করার জন্য তেমনভাবেই প্রস্তুতি নেন সুবাদার।
যুদ্ধের বর্ণনাটি এমন ছিল, মোগল নৌবহর শ্রীপুর ও বিক্রমপুরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ইতিমাম খাঁর (মির্জা নাথানের পিতা) স্থল বাহিনী নৌবহরকে অনুসরণ করে। ইতিমাম খাঁকে নৌ ও গোলন্দাজ বাহিনীর কেন্দ্রস্থল থেকে সতর্ক অবস্থায় এগিয়ে যেতে বলা হয়। মির্জা নাথানকে থাকতে বলা হয় অগ্রগামী রিজার্ভ দলের পরিচালনায়। এসব বহরের ডানে ও বামে রাখা হয়েছিল ওমরাহদের নৌবহর। এই অভিযাত্রায় পাথরঘাটা বলে একটি অঞ্চলের কথা বলা হয়েছে। সম্ভবত এখানে বারোভুঁইয়াদের নৌবহরের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। মির্জা নাথান তাঁর বর্ণনায় ‘শত্রুপক্ষের নৌকা’ বলেছেন। নাথান লিখেন-
‘...পরদিন ভোরে পূর্ব নির্দেশ মতো রণবেশে সজ্জিত বড় নৌবহর নিয়ে শাহী কর্মচারীরা স্থল ও জলপথে পাথরঘাটার মোহনার উদ্দেশে রওনা হলো। অগ্রবর্তী দল হিসেবে পাঠানো কয়েকটি নৌকা পাথরঘাটার নিকট শত্রু পক্ষের নৌকার মুখোমুখি হয়। শত্রু পক্ষের ১৫টি নৌকা এবং শাহী দলের মাত্র সাতটি নৌকা থাকার পরও শাহী নৌকা দেখা মাত্র তারা পালিয়ে যায়। সাতটি নৌকা দুই ক্রোশ পর্যন্ত তাদের অনুসরণ করে। কিন্তু নৌকাগুলো অনেক দূরে চলে যাওয়ায় তারা তাদের ধরতে পারেনি। এরপর নৌ ও স্থল বাহিনী পাথর ঘাটায় তাদের তাঁবু ফেলে। এই সময়েই পাথরঘাটায় সেনা নায়কদের কাছে ইসলাম খাঁর পত্র পৌঁছে। এতে জানা যায় ততক্ষণে ইসলাম খাঁ ঢাকায় পৌঁছে গেছেন। তিনি নানা অঞ্চলে অবস্থান নেওয়া নৌ ও স্থল বাহিনীকে ঢাকায় চলে আসার নির্দেশ দেন।’
মোগল আগমন-পূর্ব ঢাকার নাগরিক জীবন সম্পর্কে মির্জা নাথানের ভাষ্য থেকে জানা যায়। বর্তমান কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকায় এ সময় একটি দুর্গ ছিল। এই দুর্গটি ছিল আফগান বা স্থানীয় জমিদারদের গড়া। ‘ঢাকা দুর্গ’ নামে পরিচিত এই দুর্গ সংস্কার করে সুবাদার ইসলাম খাঁর আবাসস্থল বানানো হয়।
ঢাকা অধিকারের পর ইতিমাম খাঁ ও মির্জা নাথান ডেমরা খালের মোহনার দুপাশে অবস্থিত বেগ মুরাদ খানের দুর্গ দুটির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই বর্ণনায় ঢাকার অভ্যন্তরে ঢাকা দুর্গ এবং উপকণ্ঠ ডেমরায় দুটো দুর্গের অবস্থান বারোভুঁইয়াদের সময় ঢাকার গুরুত্ব নির্দেশ করে।