আলো ছড়ানোর গল্প
গজারিয়া পাবলিক লাইব্রেরি
লাইব্রেরি বিমুখ সমাজে গজারিয়ার কয়েক জন শিক্ষিত তরুণ একটা লাইব্রেরি গড়ার উদ্যোগ নেন। ২০১৫ সালের ১৯ এপ্রিল ঢাকার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে বসে তাঁরা তৈরি করেন গজারিয়া পাবলিক লাইব্রেরি।
যে কয়েক জন মানুষের লালিত স্বপ্নের ফসল এই লাইব্রেরি, আলোকচিত্রী সাহাদাত পারভেজ, নির্মাতা ইমেল হক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তৌহিদ হোসেন খান ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্রী আছিয়া আফরীন চৌধুরী তাদের অন্যতম। গজারিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহবুবা বিলকিসও সেই উদ্যোগের সারথী হয়েছিলেন।
২০১৫ সালের ২ জুন ভবেরচর কলিম উল্লাহ কলেজের কাছে একটি ভাড়া বাড়িতে এই লাইব্রেরির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়।
বিশিষ্ট কলাম লেখক ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ এর উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনের মাত্র তের দিন পর অর্থাৎ ১৫ জুন লাইব্রেরিটি গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের রেজিস্ট্রেশন লাভ করে। প্রথমে সাহাদাত পারভেজের ব্যক্তিগত সংগ্রহের দুই শত বই দিয়ে এই লাইব্রেরির যাত্রা শুরু হয়। এরপর ব্যক্তিগতভাবে বই দিয়ে সহায়তা করেন তৌহিদ হোসেন খান, জামশেদুর রহমান, ড. মুহাম্মদ আবদুল মান্নান সরকার, কাজী অনীক রহমান, সুদীপ্ত সালাম ও এ কে এম হাবিবুর রহমান প্রমুখ। এ ছাড়া প্রথম আলো গ্রন্থাগার, অনিন্দ্য প্রকাশ, অনন্যা, সূচিপত্র, পাঠসূত্র, ভাষাচিত্র, শ্রাবণ, কথা প্রকাশসহ বেশ কিছু প্রকাশনী বই দিয়ে লাইব্রেরিকে সমৃদ্ধ করেন।
শুরুর দিকে সারাদিন লাইব্রেরি খোলা রেখেও পাঠক পাওয়া যেত না। ফলে উদ্যোক্তারা হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। পরে তারা বিভিন্ন স্কুল, কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গিয়ে নানামুখী প্রচারণা চালান। শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও সমাজের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে গোলটেবিল বৈঠক, মতবিনিময় ও সভা করেন। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে স্বপ্ন দেখানোর কাজ শুরু করেন। গজারিয়ার যত ছেলেমেয়ে বর্তমানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, তারাও জড়িয়ে পড়ে এই উদ্যোগের
লাইব্রেরির ফেসবুক পেজেও ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়। ফলে এই লাইব্রেরির মাধ্যমে মানুষের মনন তৈরির আন্দোলন শুরু হয়। ছাত্র, শিক্ষক, সাংবাদিক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, চিকিৎসক, ব্যাংকার, ব্যবসায়ী, এনজিওকর্মী, সংস্কৃতিকর্মীসহ সুশীল সমাজের মানুষ এই আন্দোলনে শরিক হন।
লাইব্রেরির সভাপতি মো. আবদুল খালেক আলো জানান, ‘ইতিমধ্যেই গজারিয়া পাবলিক লাইব্রেরি মানুষের মনের হাসপাতালে পরিণত হয়েছে। লাইব্রেরিটা এখন গজারিয়ার মানুষের শেকড় সন্ধানের বাতিঘর। এখানে প্রতিদিন শিশুরা আসে, শিক্ষার্থীরা আসে, বয়স্করাও আসেন। তারা বই পড়েন, পত্রিকা পড়েন, ছবি দেখেন, নানা রকম প্রশ্ন করেন, সর্বোপরি একটা স্বস্তিময় সুন্দর সময় কাটান। বই পড়া শেষে আমরা সীমিত সাধ্যের বাচ্চাদের চকলেট খেতে দেই। অনেক সময় তা কিনতেও আমাদের কষ্ট হয়। আমাদের শৈশবে গজারিয়ায় এই রকম প্রতিষ্ঠান ছিল না। তবু আমরা আমাদের সাধ্যমতো চালিয়ে যাচ্ছি।’
লাইব্রেরির সাধারণ সম্পাদক সাহাদাত পারভেজ জানান, ‘গজারিয়ার মতো জায়গায় এই লাইব্রেরির উত্তরণ অন্ধকারে এক ঝলক আলোর মতো। মানুষের মনের ভেতরের অন্ধকার প্রতি দিন একটু একটু করে দূর দিচ্ছে এই লাইব্রেরি। এখন এই লাইব্রেরিতে পড়তে প্রতিদিন গড়ে পড়তে আসেন ৬০ থেকে ৭০ জন। এদের বেশির ভাগই তরুণ।’ লাইব্রেরিয়ান মো. ইব্রাহিম জানান, সময় মতো ফেরত দেওয়ার শর্তে এখান থেকে নিয়মিত বই নেওয়া যায়।’ লাইব্রেরির নিয়মিত পাঠক শাকিল আলম তানিন জানান, ‘পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি সহপাঠ খুবই জরুরি। সহপাঠ না করলে মনে আনন্দ পাওয়া যায় না। আর মনে আনন্দ না থাকলে পাঠ্যবই পড়তেও ভালো লাগে না।’
লাইব্রেরির ভারপ্রাপ্ত কোষাধ্যক্ষ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক জামশেদুর রহমান বলেন, আমাদের নিজস্ব কোনো ভবন নেই। নিজেদের অর্থায়ন ও সামান্য দানে চলে এই লাইব্রেরি। সরকারি ভাবে ভূমি বন্দোবস্ত পেলে আমরা ভবন তৈরির উদ্যোগ নিতে পারি। এইভাবে লাইব্রেরিটি স্থায়িত্ব লাভ করবে। এমন সামাজিক কার্যক্রমে সরকারের এগিয়ে আসা ও পৃষ্ঠপোষকতা জরুরি।
গজারিয়া লাইব্রেরির দেয়ালে টাঙানো আছে ফ্রেমে বাঁধানো গজারিয়ার বেশ কিছু দুর্লভ আলোকচিত্র। আছে গজারিয়ার ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কিত বই, সংকলন ও পুরনো দলিলপত্রের স্ক্যান কপি। বর্তমানে লাইব্রেরির সদস্য সংখ্যা চারশয়ের বেশি। বইয়ের সংখ্যা দেড় হাজারের বেশি। বই পড়া কর্মসূচি ছাড়াও গজারিয়া পাবলিক লাইব্রেরি নানামুখী কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে।
সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও শিক্ষকদের সঙ্গে সঙ্গে মত বিনিময়, গোলটেবিল বৈঠক, শিশুদের স্বপ্ন দেখানোর আসর, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক আলোচনা, ঈদ পুনর্মিলনীসহ বছরব্যাপী নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে থাকে এই লাইব্রেরি।
প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা গজারিয়া পাবলিক লাইব্রেরি। শুক্রবার ছুটির দিনেও বেলা ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা রাখা হয়। সবার জন্য উন্মক্ত। প্রতিদিন দুপুর ২টা থেকে ৩টা পর্যন্ত লাইব্রেরি বন্ধ থাকে।