পা দিয়ে লিখে পরীক্ষা, শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন পাপিয়ার
জন্মের পর থেকেই দুই হাতে শক্তি নেই। দরিদ্র বাবা-মা স্থানীয় চিকিৎসকদের দেখালেও তেমন কোনো লাভ হয়নি। কিন্তু তারপরও থেমে থাকেনি পাপিয়া। চালিয়ে যাচ্ছে লেখাপড়া। পা দিয়ে লিখে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পাসের পর এবার এসএসসি (মাধ্যমিক ও সমমান) পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে পাপিয়া।
পাপিয়া মেহেরপুর সদর উপজেলার ঝাউবাড়িয়া নওদাপাড়ার পিয়ারুল ইসলামের মেয়ে। এ বছর মেহেরপুর সদর উপজেলার ঝাউবাড়িয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে সে। আজ বৃহস্পতিবার মেহেরপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, পাপিয়া বেঞ্চে বসে পা দিয়ে লিখে পরীক্ষা দিচ্ছে।
পিয়ারুল ইসলামের দুই মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে পাপিয়া ছোট। তার পুরো নাম ববিতা আখতার পাপিয়া। জন্মের পর থেকেই দুই হাতে শক্তি না থাকায় পা দিয়েই তাকে লেখাসহ বইয়ের পাতা বের করা, খাতা বের করা, বই ঠিকমতো গুছিয়ে রাখাসহ অন্যান্য কাজ সম্পন্ন করতে হয়। তবে তাকে সহযোগিতা করে তার বড় বোন পপি খাতুনসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা। বড় বোন পপি খাতুনও এবার এসএসসি পরীক্ষায় নিচ্ছে।
এর আগে গত মঙ্গলবার বাড়িতে গিয়ে কথা হয় পাপিয়ার মা আরিফা খাতুনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘প্রতিবন্ধী হয়ে জন্ম নিয়েছে পাপিয়া। জন্মের পর থেকেই দুই হাতে তার কোনো শক্তি নেই। এলাকার বিভিন্ন ডাক্তারকে দেখিয়েছিলাম, তাঁরা বলেছেন চিকিৎসা করে কোনো লাভ হবে না। আমরা গরিব মানুষ তাই মেয়েকে বাইরের কোনো ডাক্তারকে দেখাতে পারিনি। জানি না দেখালে ভালো হতো কি না?’
পাপিয়ার মা আরো বলেন, ‘প্রতিবন্ধী হলেও আমার মেয়েকে মানুষের মতো মানুষ করার চেষ্টা করছি। সে যেন কারো কাছ হাত না পাতে, সে কারণে তাকে লেখাপড়া শেখাচ্ছি। পড়ালেখায় তার খুব আগ্রহ। যতদূর পারি তাকে পড়ালেখা করাব।’
পাপিয়া খাতুনের বড় বোন পপি খাতুনও এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। সে বলে, ‘আমি তার সমস্ত কাজ করে দিই। প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হতো। আল্লাহ কেন যে তার হাতে শক্তি দিল না! তবে এখন আর কষ্ট হয় না। এখন গর্ব হয়, এই কারণে যে আমার বোন হাতে লিখতে না পারলেও পা দিয়ে লেখে। সে মাধ্যমিক স্কুল শেষ করে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে।’
পাপিয়া বলে, ‘প্রতিবন্ধী হলেও সমাজের বোঝা হতে চাই না। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে চাই। নিজেকে একজন শিক্ষিকা হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখি।’ সমাজের অসহায় দুস্থদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখাতে চায় পাপিয়া।
সে আরো বলে, ‘আমি প্রতিবন্ধী হওয়াতে আমাকে এ পর্যন্ত নিয়ে আসাতেই অনেকের সহযোগিতা রয়েছে। তাদের মধ্যে তার বাবা, মা, ভাই, বোন, তার সহপাঠীরা এবং স্কুলের শিক্ষকরা তাকে সহযোগিতা করেছেন।’ সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে পাপিয়া। পাপিয়ার সহপাঠীদের বিশ্বাস পা দিয়ে লিখেই সে ভালো ফলাফল করবে।
ঝাউবাড়িয়া স্কুলের সহকারী শিক্ষক কামরুল হাসান বলেন, ‘পাপিয়া সমাজের একটি উদাহরণ। হাতে শক্তি না পেলেও পা দিয়ে লেখার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে সে। তার অদম্য আগ্রহই তাকে সমাজের একটি উচ্চ আসনে নিয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস।’
পাপিয়ার হাতের সমস্যা নিয়ে কথা বললে মেহেরপুরের সিভিল সার্জন ডা. রাশেদা সুলতানা বলেন, এটা জেনেটিক ডিজঅর্ডারের কারণে হয়ে থাকে। এ ধরনের রোগের কোনো চিকিৎসা নেই।
জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা সুভাষ চন্দ্র গোলদার বলেন, প্রতিবন্ধী হিসেবে পাপিয়ার জন্য প্রতিটি পরীক্ষায় অতিরিক্ত ২০ মিনিট সময় দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।
মেহেরপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) পরিমল সিংহ বলেন, ‘পাপিয়ার বিষয়টি জেনেছি। তার লেখাপড়া চালিয়ে নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’