অভিমত
কোন পথে চলেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থিতিশীলতা ও মানসম্মান এখন দোদুল্যমান পেন্ডুলামে দুলছে। এখানকার হালের চালচিত্র ভীষণ অদ্ভুত রূপ ধারণ করেছে। মধ্যরাতে প্রতিবাদকারী ছাত্রছাত্রীদের পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। আদালতে তোলা হয়। জামিন মঞ্জুর । দুধর্ষ অপরাধীর মতো হাতকড়া পরিয়ে পুলিশি প্রহরায় হাসপাতালে অসুস্থ শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। ভাঙচুরের মামলা দেওয়া হয়েছে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়। আর ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছে রানা ও আরাফাত নামের দুই শিক্ষার্থীর মর্মন্তুদ অকাল মৃত্যু।
প্রশাসনিক গোয়ার্তুমি ও শিক্ষার্থীদের মনস্তত্ত্ব না বুঝে ক্রমাগত ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং এর পরিণতিতে তুলকালাম কান্ডকারখানার অঘটনই এখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের করুণ নিয়তি। বিশ্ববিদ্যালয় কার জন্য ? প্রথমত , দ্বিতীয়ত এবং তৃতীয়ত শিক্ষার্থীদের অধ্যয়নের জন্য। তাদের মানুষ করে গড়ে তুলবার জন্য। তারপর আসবে শিক্ষকদের অধ্যাপনার পর্বটি। এর কারণ কোমলমতি শিক্ষার্থীরা না থাকলে শিক্ষক তথা প্রশাসকদের ঐ ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় সবুজ ক্যাম্পাসে শুধু শুধু হাওয়া খেয়ে কোনো কাজ নেই। তাহলে কেউ কি এই কথা বলতে পারেন, কোনো শিক্ষার্থী যদি অপঘাত বা দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান বা স্বাভাবিক মৃত্যুও হয় তার সৎকার বা জানাজা কোন যুক্তিতে ওই শিক্ষার্থীর ভালোবাসার ক্যাম্পাসের পবিত্র অঙ্গনে হতে পারবে না?
গেল শুক্রবার ভোরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আল বেরুনী হলের আবাসিক ছাত্র ৪৩তম ব্যাচের মার্কেটিং বিভাগে অধ্যয়নরত নাজমুল হাসান রানা ও মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের আরাফাত হোসাইন ক্যাম্পাসে ফিরছিলেন। অটোরিকশা যোগে ক্যাম্পাসে ফেরার সময় ক্যাম্পাসের সন্নিকটে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে এক যাত্রীবাহী বাস পেছন থেকে তাঁদের ধাক্কা দেয়। দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই রানা মারা যান। গুরুতর আহত আরাফাত সাভার এনাম মেডিকেল কলেজে আইসিউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওইদিনই দুপুরের দিকে প্রাণ হারান। এমন একটি মর্মান্তিক ঘটনার শিকার হওয়া শিক্ষার্থীদের সহপাঠী ও বন্ধুরা শোকে বিহ্বল হয়ে পড়ে। এমন একটা সময়ে সেই শোকস্তব্ধ শিক্ষার্থীরা পরের দিন জানলেন, নিরাপত্তা ঝুঁকির অজুহাত দেখিয়ে রানা ও আরাফাতের মরদেহ হাসপাতাল থেকে ক্যাম্পাসে এনে জানাজা অনুষ্ঠিত হতে দেওয়া হবে না। ক্ষোভে ফেটে পড়লেন শিক্ষার্থীরা। উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে তাদের মধ্যে। এবং জাহাঙ্গীরনগর ক্ষেপে গেলে তার প্রথম ঝাঁঝ গিয়ে পড়ে ক্যাম্পাস সংলগ্ন মহাসড়কে। কয়েক ঘন্টা ওই সড়ক বন্ধ থাকলে ভোগান্তিতে পড়ে হাজার হাজার যাত্রী। কিন্তু শিক্ষার্থীদের ন্যায্য প্রতিবাদ ও দাবির কাছে ওই ভোগান্তি পাত্তা পায় না।
বাসচাপায় প্রাণহারানো জড়িত ব্যক্তিদের বিচারসহ কয়েকটি দাবিতে শনিবার দুপুরে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধের পর ব্যাপক পুলিশি মারধর, টিয়ার শেল নিক্ষেপ ও নির্যাতনের শিকার হন প্রতিবাদকারীরা। উপায়ন্তর না পেয়ে তাদের ক্ষোভ গিয়ে আছড়ে পড়ে উপাচার্যের বাসভবনে। ভাঙচুরের মুখে পড়ে সেখানকার ফটক ও জানালার কাঁচ; লাঞ্ছনা বরণ করতে বাধ্য হন কিছু শিক্ষকও। এরপর প্রশাসনের পালটা আক্রোশ মেটাতে তাদের ইন্ধনে মধ্যরাতে ১০ ছাত্রীসহ ৪২ শিক্ষার্থীকে আটক করে পুলিশ। বিদ্যাপীঠ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। আটকের পরের দিন শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে তোলা হলে আদালত তাদের জামিন মঞ্জুর করেন।
এখন কথা হলো, পুরো পরিস্থিতিটা সৃষ্টি করবার পেছনে দায় কার ? অবশ্যই কোনো শিক্ষক কাম প্রশাসকের। সবার আগে দায় নিতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কারণ তিনিই বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক। তারপর দায় বর্তাবে সহ-উপাচার্য, রেজিস্ট্রারসহ তাঁর সভাসদদের ওপর এবং নিরাপত্তার অজুহাতে অকালে প্রাণ হারানো শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে জানাজা পড়তে না দেওয়ার জন্য প্রক্টর জবাবদিহি করতেই হবে।
এই ঘটনায় সম্পৃক্ত একজন প্রতিবাদকারী জাবি সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক ও প্রতিভাবান থিয়েটারকর্মী নাজমুল হোসেনকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে হাতকড়া পরিয়ে। এমন ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় এখন ভাইরাল। এই ঘৃণ্য ঘটনায় জাবি প্রশাসনের কপালে নিন্দা ও ঘৃণা ছাড়া কিছুই জুটছে না।
নাজমুল কি দাগি অপরাধী ? মাননীয় উপাচার্য আপনার যদি শিক্ষক হিসেবে সামান্যতম বোধ থাকত , আপনি যদি মা হয়ে থাকতেন তবে পুত্র কন্যাদের এমন অপমানের ইতিহাস লিখে নিজের হাত কলঙ্কিত করতে পারতেন না!
প্রিয় উপাচার্য, উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য আপনি নিজে ও আপনার প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিরা দায়ী। আমাদের প্রাণের ক্যাম্পাস জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক থাকবার নৈতিক অধিকার হারিয়েছেন আপনি। প্রশাসনিক বর্বরতার ছাপ এখন আপনাদের সর্বাঙ্গে। চরম ধিক্কার ও নিন্দা জানানো ছাড়া আমাদের আর কী উপায়?
যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে আপনারা জাহাঙ্গীরনগরের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করেছিলেন , নৈতিকতা জলাঞ্জলি দিয়ে নিজেদের কোমলমতি সন্তানদের পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে আপনারা শপথ ভঙ্গ করেছেন। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের ভাঙচুরের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদের দায়ী ও দোষি সাব্যস্ত করে শাস্তির আওতায় আনা হবে। কিন্তু শিক্ষার্থীদেরকে উসকে দিয়ে তাদের রাস্তায় নামতে বাধ্য করে , আবার তাদেরকেই পুলিশের গরাদখানায় বন্দি করে দিয়ে তদন্ত ও বিচার নামের প্রহসন করবার অধিকার কি আপনাদের আছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন?
ন্যায়ের পথে অবিচল শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা দাবি করলেও উপাচার্য বলেছেন , শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা তিনি তুলে নিতে পারবেন না। শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার বিরুদ্ধে দাবি তুলেছে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগও। কিন্তু কাউকে পাত্তা দিচ্ছেন না উপাচার্য।
অবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়া হোক, ক্লাস-পরীক্ষা চলুক ঠিকঠাক। সত্বর পুলিশের কাছে আটক হওয়া শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা থেকে মুক্তি দিয়ে গভীর উৎকন্ঠায় থাকা অভিভাবকদের কাছে সসম্মানে তাদের ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানাই। ৭৩-এর বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্সকে এবার পর্যালোচনা করে সময়োপযোগী করা হোক।
তাই বর্তমান প্রশাসনের পশ্চাৎপদ কর্মকাণ্ডে কবি শামসুর রাহমান আমাদের কণ্ঠে সশব্দে ভর করেন: উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার্ড গ্রাজুয়েট