গল্প
বৃষ্টি
এক.
ইতালিতে খুব একটা ভাষা শিখতে হয় না। শুধু রাতভর পরিশ্রম করতে পারলেই দেদার টাকা কামানো যায়। টাকা কামানোর জন্য বেশি ভাষা শিখতে হয় না। বুঝতেও হয় না। কোয়ান্তো কস্তা (কত দাম), প্রেন্দি ফিউরি? (ফুল লাগবে?), প্রেগো (স্বাগতম), গ্রাৎছে (ধন্যবাদ), বনো ছেরা (শুভ সন্ধ্যা), বনো নত্তেসহ (শুভ রাত্রি) আর কয়েকটা শব্দের অর্থ জানলেই টাকা কামানোর পথটা সহজ হয়ে যায়। ফুল বিক্রি করার জন্য এর চেয়ে বেশি ভাষা না জানলেও চলে।
ইদ্রিস আলীর ১৬ বছর বয়সী ছেলে সেলিম যেদিন অনেক কষ্ট করে রাশিয়া হয়ে ইউক্রেনের বর্ডার পেরিয়ে হাঙ্গেরির জেলে তেরো মাস জেল খেটে এক পাইক্যার (পাকিস্তানি দালালদের এ নামেই ডাকা হয়) মাধ্যমে যখন এক রাতে ট্রেন থেকে মিলান সেন্ট্রাল স্টেশনে এসে নামল, সেদিন ইদ্রিস আলীর আনন্দ দেখে কে! কত দিন পর বাবাকে দেখে ছেলে যে কতক্ষণ ঝরঝর করে কেঁদেছিল, তার সাক্ষী পাইক্যা দালাল হাফিজ। কান্নাকাটির ব্যাপারটা হাফিজের খুব একটা পছন্দের না। সে বিরক্ত হয়ে ইদ্রিসকে বলল, মুঝে যা না পারে গা। হাফিজের অবশ্য পরের কথাগুলো বলতে হয়নি। ইদ্রিস মিয়া এক হাজার ইউরো দিয়ে হাফিজকে বিদায় করে দিল।
স্টেশন থেকে ফেরার পথে ইদ্রিস মিয়া সেলিমকে মেসবাড়িতে সবার সঙ্গে কীভাবে মিলেমিশে থাকতে হবে, সে কথা ইনিয়ে-বিনিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে। সেলিমও বাবার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে এমন ভাব দেখিয়ে মাথা ঝাঁকাল। এ ছাড়া সেলিমের আর কী-ই বা করার ছিল? বাবা তার পেছনে গুনে গুনে বারো লাখ টাকা খরচ করে তাকে দেশ থেকে ইতালি নিয়ে এসেছে। পথে কত যে কষ্ট, কত যে ভোগান্তি! তবু এত কষ্ট, এত ভোগান্তির পথ পেরিয়ে সেলিম তার স্বপ্নের দেশ ইতালিতে ঢুকতে পেরেছে। বাবা কতবার টেলিফোনে সেলিমকে বুঝিয়েছে, তর ইতালি আহনের দরকার নাই। বাবা, তরে ট্যাকা দিয়া দুবাই পাঠাই। নিশ্চিন্ত কাম, মাস শেষে বেতন। তুই ভালো থাকবি। ইতালিতে অনেক কষ্ট। সারা রাত পথে ঘুরে ঘুরে ফুল বিক্রি করতে হয়। কোনো দিন ফুল বিক্রি হলে একশ’-দেড়শ’-দুইশ’ ইউরোর ব্যবসা হয়। বাংলা টাকায় গুণ করলে প্রতি রাতে লাভের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় দশ-পনেরো-বিশ হাজার টাকা। আবার এমন রাতও যায় একটা ফুলও বিক্রি হয় না। খালি হাতে ভোররাতে ঘরে ফিরতে হয়। সারা রাত পথে পথে, বারে বারে, হোটেল, ডিস্কোটেকা, পাব-এ ঘুরতে ঘুরতে পা ফুলে যায়।
সেলিম বাবার সেসব কথা শোনেনি। সে ফুল বিক্রি করে অনেক টাকা কামাই করবে। বাবার সঙ্গে থাকবে। বাবার দেখভালও সে করবে। পাশাপাশি ফুল বিক্রির কাজটা তো রইলই।
গরম ভাত, গরুর মাংসের ঝাল তরকারি আর ঘন ডাল দিয়ে সেলিম পেটভরে ভাত খেল। ক্লান্ত সে। বিছানায় শুলো। খাওয়া শেষ হলে সেলিমকে রেখে আগে থেকে তৈরি করে রাখা ফুলের কয়েক গোছা (একেক গোছায় বিশটা ফুলের স্টিক থাকে) নিয়ে ইদ্রিস মিয়া গরম কাপড় আর মাথায় বানর-টুপি পরে বেরিয়ে পড়ল। বাইরে তখন ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে সেলিম বাবার চলে যাওয়া দেখে আর ভাবে, এই শীতের রাতে বাবা ফুলগুলো নিয়ে কোথায় যাচ্ছে? আর এত ফুল বিক্রিই বা করবে কার কাছে? বাবা চলে যাওয়ার পর কম্বলের নিচে শুয়ে থাকা সেলিম টের পেতে থাকে ঘরটা যেন আস্তে আস্তে বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। ঘরের ভেতর হিটার চলছে, তারপরও গরম কাপড়চোপড় পরা কম্বলের ভেতর শুয়ে থাকা সেলিমের শরীর ঠান্ডা হতে থাকে। কম্বলের ভেতর শুয়ে থাকা সেলিমের চোখ ভেঙে ঘুম আসার কথা। ঘুমের পরিবর্তে বাবার জন্য তার মনটা কেমন যেন নরম হতে থাকল।
রাশিয়া, ইউক্রেন, হাঙ্গেরিতে সেলিম এ রকম নিশ্চিন্ত ঘর আর বিছানা পায়নি। তখন ভালো করে একটু ঘুমানোর কত চেষ্টা যে সে করেছে! কিন্তু নিশ্চিন্তে ঘুমানোর ঘুম তার আর আসেনি। আর আজ তেরো মাস পর বাবার কাছে এসে নিশ্চিন্ত ঘর আর তার চেয়েও নিশ্চিন্ত বিছানা পেয়ে সেলিমের চোখে ঘুম আসে না। বাইরের হাড়-কাঁপানো শীতের কনকনে ঠান্ডা বাতাস দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে সেলিমের কম্বল ভেদ করে ওকে ঘাই মারছে।
কম্বলের ভেতর ঘুমিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সেলিমের ঘুরেফিরে শুধু বাবার কথা মনে হয়েছে। এত ঠান্ডার মধ্যে কী দরকার ছিল ফুল বিক্রি করতে যাওয়ার? একদিন ফুল বিক্রি না করলে কী এমন ক্ষতি! এসব চিন্তা করতে করতে কখন যে ঘুমের অতলে সে তলিয়ে গেছে, টেরও পায়নি সেলিম।
দুই.
অনেক রাতে কাজ শেষ করে ঘরে ফিরছি। রেস্টুরেন্টে কাজ করি। ভদ্রলোকরা খাওয়া-দাওয়া শেষ করলে তবেই আমাদের ছুটি। প্রায় দিনই কাজ থেকে বের হতে হতে বেশ রাত হয়ে যায়। রান্নাঘরের কাজ। দুইবেলার কাজে প্রচণ্ড বিরক্তি লাগে। কিন্তু তারপরও করার কিছু থাকে না। ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক, কাজ করতে হবে। জীবন বাঁচিয়ে রাখতে হলে বিদেশবাড়িতে ‘কামলা’ দিতে হয়। আমার বন্ধুরা এই কামলা শব্দটা পছন্দ করে না। বন্ধুদের কেউ কেউ আমাকে এ নিয়ে তাদের আপত্তির কথাও জানিয়েছে। বন্ধুদের ভাষায় কাজ করাকে লাভোরো বলা উচিত। ইতালিয়ান ভাষায় এর মানে হলো কাজ করা বা জব করা। আমার কাছে লাভোরো শব্দটা ভালো লাগে না। এখন দেখছি আমার দেখাদেখি অনেক বাঙালি কামলা শব্দ ব্যবহার করে।
সেদিন আমি কাজ থেকে ফিরছি অনেক রাতে। মিলানের আকাশ বিকেল থেকে মেঘলা। টেলিভিশনের আবহাওয়ার সংবাদে জানান দিয়েছে, রাতে বৃষ্টি হতে পারে। এখানকার আবহাওয়ার পূর্বাভাস একশ’ ভাগ সত্যি হয়।
কাজ থেকে বেরিয়ে কিছুটা পথ হেঁটে রাতের শেষ মেট্রোতে চড়তে হয়। এখানকার মেট্রো ব্যবস্থা এতটাই দ্রুত যে পনেরো মিনিটে দশ-পনেরো মাইল নির্বিঘ্নে পাড়ি দেওয়া যায়। মেট্রো থেকে নেমে পড়িমরি করে ওপরে উঠে বাসের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। রাতের বেলা মেট্রোর সঙ্গে মিলিয়ে বাস সার্ভিস। বাস মিস করলে অনেকটা পথ হেঁটে বাড়ি ফিরতে হয়। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। সেইসঙ্গে কনকনে ঠান্ডা বাতাস। আমার পিঠ-ব্যাগে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট আর ছাতা। ছাতাটা মাস্ট। বৃষ্টি-বাদলের দিনে এখন সবাই ছাতা নিয়ে বেরোয়। এটা কমন দৃশ্য।
মিনিট দশেক অপেক্ষার পর হলুদ রঙের বাস এলো। বাস স্টপেজে থামতে ঝপ করে বাসে উঠে পড়লাম। বাস চলছে। সামনের স্টপেজ থেকে বাসে একজন পরিচিত বাঙালি উঠলেন। এর আগে এই ভদ্রলোককে আমি মিলানের বাঙালিপাড়ায় সেখানে দেখেছি। ভদ্রলোক ফুল বিক্রি করেন। ফুল ইদ্রিস বললে তাকে মিলানের বাঙালিরা চেনে। বয়স পঞ্চাশ পেরিয়ে গেলেও শরীরের গড়নে তাকে মনে হবে ত্রিশ। চিকন-চাকন গঠন। লোকটা বাসে উঠে জড়সড় হয়ে একটা সিটে বসলেন। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হলো। আমার সামনের সিট খালি দেখে তাকে এখানে এসে বসতে বললাম। তিনি উঠে এসে আমার পাশে বসলেন। বিদেশে যারা চাকরি-বাকরি করে, তাদের মনমানসিকতা একরকম আর যারা ছাড়া-গরুর মতো ফুটপাতে ব্যবসা-বাণিজ্য করে, তাদের মেজাজ-মর্জি থাকে অন্য রকম। ইতালিতে রাস্তার ওপরেই বেশির ভাগ ব্যবসা হয়। আবার কেউ রাতের বেলা হাতে নিয়ে ফুল বিক্রি করে।
সারা রাত রেস্টুরেন্ট, ডিস্কোটেকা, বার, পাব-এ ঘুরে ঘুরে ফুল বিক্রি করে। ভোররাতে ঘরে ফেরে। খুব কষ্টের কাজ। এই কাজটা করতে পারলে একজন মানুষ দু-তিনজন চাকরিজীবীর সমান উপার্জন করতে পারে। যারা ফুলের ব্যবসা করে, তারা সারা দিন শুয়ে-বসে কাটান। বিকেলে ফুলের স্টিক সাইজ করেন। তারপর রাতে গরম ভাত খেয়ে ফুল নিয়ে নেমে পড়েন রাস্তায়।
ভদ্রলোক আমার সামনের সিটে এসে চুপ করে বসে রইলেন। বেশ কিছুদিন হলো ইদ্রিস তার একমাত্র ছেলেকে ডাংকি (অনেকে একে টারজান ভিসা বলে) ভিসায় তার কাছে নিয়ে এসেছেন। ছেলেকেও ফুল বিক্রিতে লাগিয়ে দিয়েছেন। বাপ-ছেলে মিলে ফুল বেচে ভালো কামাই-রোজগার। সারা দিন ঘুম দিয়ে সন্ধ্যার পর ফুল নিয়ে বেরিয়ে পড়া। ভাগ্য ভালো হলে একশ’-দেড়শ’ ইউরো নিয়ে ঘুম-ঘুম চোখে সকালে বাসায়। আমি দেখলাম ভদ্রলোকের হাত খালি। ফুল নেই। সম্ভবত বাসায় ফিরে যাচ্ছেন তিনি।
খালি হাতে হাতে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন দেখে আমি বললাম, ভাই ব্যাপার কী? এত সকাল সকাল বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন যে?
একটা পার্টি ভালো দামে সব ফুল কিনে নিয়েছে, তাই বাসায় যাচ্ছি আরো ফুল আনতে। বলে ভদ্রলোক বললেন, আজ বেশ লাভ হয়েছে। ইদ্রিস মিয়ার চোখ-মুখ তাই বলে দিচ্ছে। গ্রামীণ অবয়ব তার চোখে-মুখে।
বাইরে তখন বৃষ্টি। বাসের জানালায় বৃষ্টির ফোঁটা ঘন হয়ে ওঠে। ফলে বাসের ভেতর থেকে বাইরের পথঘাট, বাড়িঘর কেমন ধোঁয়াটে লাগে। আমি ভদ্রলোককে দেখতে থাকি আর নিজের কথা ভাবি, দুইবেলা কামলা দিয়ে মাস শেষে যে টাকা পাই, এই ভদ্রলোক ফুল বিক্রি করে এক সপ্তাহে তার চেয়ে বেশি কামান।
আমি বললাম, বৃষ্টির দিন ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নেন। ফুল তো বিক্রি করে এসেছেন আর আপনার ছেলে তো আছেই। দুজন মিলে তো ভালো আয়-রোজগার করছেন। ছেলেকে এনে একটা কাজের কাজ করেছেন। আপনার কষ্ট কমেছে। এই বয়সে আর কত কষ্ট করবেন? এতটুকু বলে আমি একটু থামলাম। তারপর বললাম, ছেলে আজ ফুল নিয়ে কোথায় ব্যবসা করতে গেছে?
যারা ফুল বিক্রি করে, তাদের নির্দিষ্ট কিছু জায়গা থাকে। কেউ কারো জায়গা কাউকে দেয় না। লোকেশনও বলে না। জায়গা নিয়ে একটা লুকোচুরির ব্যাপার এদের মধ্যে থাকে।
আমার কথা শুনে ভদ্রলোক একটা হাসি আমার দিকে ছড়িয়ে দিয়ে বাইরের আকাশ দেখিয়ে বললেন, দেহেন না বিষ্টি-বাদলার দিন। পোলারে আজকা ঘরে থাকতে কইছি। পোলায় ঘুম পাড়তাছে বলে তিনি পরিতৃপ্তির একটা হাসি হাসলেন। বাস তখন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে মিলান শহরের ফাঁকা রাস্তা দিয়ে ছুটে চলেছে।
বাসের ভেতর এক ধরনের হিটার থাকে, ফলে শীতের ধাক্কাটা তেমন একটা লাগে না। ভদ্রলোকের কথা শুনে আমার মনে হলো, বাসের ভেতর এতক্ষণ চলতে থাকা হিটারটা যেন আর ঠিকমতো কাজ করছে না। একটা শীতার্ত হাওয়া বাসের মধ্যে ঢুকে আমাকে শীতগ্রস্ত করে তুলল। আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকি, কিন্তু কথা বলার ভাষা খুঁজে পাই না।
দুই স্টপেজ পরে এসে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। সামনের স্টপেজে নেমে যাবেন। আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তিনি বাসের দরজার কাছে চলে গেলেন। তারপর একসময় নেমে গেলেন। আমি বাসে বসে বসে ঘুমিয়ে থাকা এক ছেলের বাবাকে দেখি ঘুম ঘুম চোখে ফুল নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে। তার মাথায় ছাতা। ছাতার ওপর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি।
আমি ঝাপসা চোখে বৃষ্টির ভেতর একজন বাবাকে অপলক দেখতে থাকি। তিনি বৃষ্টি মাথায় নিয়ে হাঁটছেন।