কয়লাকাণ্ডে জড়িতদের অবশ্যই বিচার হবে
দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে কয়লা গায়েবের ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ তৈল ও গ্যাস করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) চেয়ারম্যান আবুল মনসুর মো. ফয়জুল্লাহ। একই সঙ্গে আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যেই কয়লা উত্তোলন শুরু হবে বলে তিনি জানান।
আজ শুক্রবার দুপুরে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি ও তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিদর্শন করেন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানসহ বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের চার সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল।
এ সময় বিদ্যুতের কোনো ঘাটতি নেই বলে উল্লেখ করেন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। তবে, চাহিদা মেটাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বাড়তি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে তাঁরা জানান।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান আবুল মনসুর মো. ফয়জুল্লাহ বলেন, ‘অবশ্যই অভিযুক্ত যারা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এইটা তো কোনো, আমাদেরকে এতো প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে। আমরা তো কোনো অবস্থাতেই এটাকে হালকাভাবে দেখার কোনো কারণ নেই। আমরা চাচ্ছি, যত তাড়াতাড়ি কয়লা উৎপাদনে যেতে পারি। চাইনিজ কন্ট্রাক্টর যারা, তাদেরকে বলেছি, সময়টাকে কমিয়ে আনতে। এবং তারা সেটা আমাদের সঙ্গে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে। আমরা বিশেষ করে আমাদের এখানে লোকাল যারা শ্রমিক আছে, তাদের কাছেও কৃতজ্ঞ। যারা ছুটিতে ছিলো, এখানে আমার সঙ্গে শ্রমিক নেতাদেরও কথা হয়েছে। তারা সবাই এখন কাজ করছেন। তাঁরা ছুটিও নিচ্ছেন না। এবং চাইনিজ অনেকে ছুটি নিয়েছিল শ্রমিক। তারা আবার ফেরত এসেছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, আমরা আশা করছি, সেপ্টেম্বরের দুই/তিন তারিখের মধ্যেই আমরা কয়লা উৎপাদনে যেতে পারব।’
‘ভেতরের লোকই লোপাট করেছে’
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, ‘গত কয়েক দিন যাবত যেই জিনিসটা পত্র-পত্রিকায় লিখা হচ্ছে, সবাই জানে। যে এখানে কোল মাইনে, কয়লার যে স্টকটা থাকার কথা ছিল, সেই স্টকটা নেই। সেটা লোপাট হয়েছে, যেকোনোভাবেই হোক। সেটার উপরে আমরা থানায় মামলা করেছি। যে, আমার যে পরিমাণ কয়লা থাকার কথা ছিলো, সেই পরিমাণ নাই। আমরা মনে করি, এটা একটা সিকিউরড এনভাইরনমেন্ট। এবং এখানে বাইরের লোক ঢুকতে পারে না। যদি কিছু নাই থেকে থাকে, তাহলে এর দায়দায়িত্ব কোল মাইনে যারা আছে, অবশ্যই তাদের। যদি কয়লাটা চুরি হয়েও থাকে বা যদি লোপাট হয়ে থাকে, তাহলে তাদের মাধ্যমেই লোপাট হয়েছে। এবং সেই কারণে আমরা ইনিশিয়াল কেস করেছি। আজকে আমরা দেখতে এসেছিলাম, যে এখানে যারা দায়িত্বে ছিলো, তাদের বক্তব্য কী? এবং ফিজিক্যালি কয়লার পরিস্থিতি কী সেটা দেখতে এসেছিলাম। একই সঙ্গে কয়লার যে মূল গ্রাহক ছিলো, পাওয়ার স্টেশন। সেই পাওয়ার স্টেশনে এই কয়লার ঘাটতিটা কিভাবে পূরণ করা যায়, আমাদের প্রোডাকশন কবে নাগাদ শুরু হবে এবং কবে নাগাদ আমরা তাদের চাহিদামতো কয়লা সাপ্লাই দিতে পারবো, সেগুলো দেখতে আসছিলাম।’
‘মাইনিং কোম্পানির লোক বলছে, সিস্টেম লস’
আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম আরো বলেন, ‘এখানে আমাদের কোল মাইনের সঙ্গে যারা সরাসরি জড়িত, মাইনিং কোম্পানির যে সমস্ত লোকজন, তারা একটি বক্তব্য বলছেন, সেটা আমরা সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করিনি। এটা তদন্তসাপেক্ষ। তাঁরা বলছেন যে, ২০০৫ সাল থেকে এই স্টকটা প্রতি বছর মেলানো হয়নি। ২০০৫ সাল থেকে খাতা-কলমে যে স্টকটা ছিলো, সেই স্টকের সঙ্গে ফিজিক্যাল যে স্টক ভেরিফিকেশন, সেটা বছর বছর যে অ্যাডজাস্ট করে আসা, এটা করা হয়নি। তারা বলছেন যে, আমরা কোনোকিছু চুরি করিনি বা লোপাট যায়নি। এটা শুধুমাত্র হিসাবের ভুল। কিউমিলিটিভ যে সিস্টেম লস, সেই সিস্টেম লসের কারণেই এই ঘাটতিটা হয়েছে। সেটা আমরা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করি না। কারণ এটা বিশ্বাস করাইতে হইলে আমাকে প্রমাণ দিয়ে বিশ্বাস করাইতে হবে। তো আমরা এটাও পরীক্ষা করবো। খাতা-কলমের বিষয়টা আমরা যাচাই করে দেখবো। তাঁরা যে দাবিটা করছেন, সেই দাবিটা কতটুকু, এবং একই সঙ্গে শুধু আমরা না, আমরা ছাড়াও এখানে তদন্ত কমিটি, দুদকের থেকে তদন্ত করা হচ্ছে। আমাদের যে মামলা হয়েছে সে মামলার তদন্ত হবে। যারা এক্সপার্ট টিম আছে, তাঁরাও দেখবেন। এটা দেখে জানা যাবে যে, এটা কি তাদের দাবি অনুযায়ী সিস্টেম লস নাকি চুরি করছে? যদি খাতা-কলমের হিসাবের গড়মিল নয়, সত্যিকার অর্থেই ঘাটতি হয়ে থাকে, তাহলে সেই দায়দায়িত্ব অবশ্যই আমার খনিতে যারা কর্মরত আছে তাদের। এবং এজন্যে তাদের যথাযথ কঠোর শাস্তি আমরা নিশ্চিত করবো।
‘পিক আওয়ারে বিদ্যুৎ ঘাটতি হচ্ছে’
বিদ্যুৎ ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব আহমেদ কায়কয়াজ বলেন, ‘বিকল্প না মূল ব্যবস্থাই নেওয়া হয়েছে। সেটা হচ্ছে আপনার, আমাদের কাছে যতগুলি বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে। তাতে বাংলাদেশে চাহিদা বর্তমানে যা আছে, মেটানোর সক্ষমতা আমাদের রয়েছে। বড়পুকুরিয়ায় যে তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রটা আছে, এটা কয়লার উপরেই সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ছিল। এবং আসলে বিভিন্ন জায়গায় বিদ্যুৎকেন্দ্র করাই হয় কিন্তু, লোড ব্যালেন্স করার জন্য, এখানে ব্যালেন্সিংয়ের একটু অসুবিধা হচ্ছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে সর্বোচ্চ আটটা জেলাকে আমাদের একশ থেকে দেড়শ মেগাওয়াটের ঘাটতি হয় পিক আওয়ারে। যেমন আজকে সকাল থেকে আপনারা কি কোথাও দেখেছেন যে ঘাটতি? মূল ঘাটতিটা হয় কিন্তু আপনার পিক আওয়ারে। পিক আওয়ার বলতে আমরা বুঝি, সাতটা থেকে রাতের ১০টা। আমরা সমস্ত জায়গায় মাইকিং করছি, মাইকিং করে করে এক ঘণ্টা করে সেটাকে ডিস্ট্রিবিউট করে দিচ্ছি। আর এই জায়গায় আরেকটা মূলত যে সমস্যা, জ্বালানি বিভাগ কিন্তু, আমাদের উপকার করেছে। আমরা কিন্তু সিরাজগঞ্জে, গ্যাস সরবরাহের ঘাটতি ছিলো, সেখানে তারা বাড়িয়ে দিয়েছে। তার পরিপ্রেক্ষিতে কিন্তু এই লোডশেডিংয়ের মাত্রা আরো কমে আসছে। সুতরাং বর্তমানের যে পরিস্থিতি তাতে বিদ্যুতের কিন্তু ব্যাপক কোনো পরিবর্তন হয় নাই। আমার ঘণ্টাখানেকের একটা ডিস্ট্রাপশন আসছে।’
কয়েকদিন আগে দেশের একমাত্র কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে এক লাখ ৪২ হাজার মেট্রিকটন কয়লা গায়েব হয়ে যাওয়ার অভিযোগ ওঠে।
বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি সূত্র জানায়, খনির ইয়ার্ড থেকে এক লাখ ৪২ হাজার টন কয়লার হদিস নেই। কয়লার অভাবে বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে বিষয়টি বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) পেট্রোবাংলাকে জানায়। তখনই কয়লা উধাও হওয়ার ব্যাপারটি প্রকাশ্যে আসে।
এদিকে, এ ঘটনা প্রকাশ্যে এলে কয়লা খনির চার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় পেট্রোবাংলা। এদের মধ্যে, বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির মহাব্যবস্থাপক (মাইন অপারেশন) নুরুজ্জামান চৌধুরী ও উপমহাব্যবস্থাপক (স্টোর) খালেদুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
এরপর পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন) কামরুজ্জামানকে আহ্বায়ক করে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়।
এ ছাড়া এ ঘটনায় তদন্ত করতে গত ২৩ জুলাই কয়লা খনি পরিদর্শনে যায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল। পরিদর্শনে গিয়ে কয়লা গায়েবের প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছেন বলে জানান দুদক কর্মকর্তা বেনজীর আহম্মেদ।