প্রদোষে প্রাকৃতজন : প্রান্তিক মানুষের জীবন্ত কোলাজ
গত বছরের ২৫ জানুয়ারি সকালবেলায় প্রিয় সাহিত্যিক শওকত আলী জীবনকে শেষ আলিঙ্গন জানান। দেখতে দেখতে বছর ঘুরে এলো। সদা স্বাধীনচেতা তাঁর সত্তার প্রতি জানাই অপরিসীম শ্রদ্ধা।
বাংলা সাহিত্যের ভূগোলে যে কজন কথাসাহিত্যিক তাঁদের পদছাপ স্পষ্ট করে গেছেন, শওকত আলী তাঁদের অন্যতম। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বাংলা সাহিত্যের যে উচ্চতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন, প্রয়াত কথাসাহিত্যিক শওকত আলীকে আমি সেই উচ্চতায় দেখি। বিভিন্ন দশকে বাঙালি মধ্যবিত্তের চিন্তাধারার যে পরিবর্তন ঘটেছে, তা উঠে এসেছে তাঁর স্বাতন্ত্র্য লেখনীতে। একাধারে লেখক, সাংবাদিক ও শিক্ষক শওকত আলীর জন্ম ১৯৩৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি। প্রদোষে প্রাকৃতজন, দক্ষিণায়নের দিন, কুলায় কাল স্রোত, শেষ বিকেলের রোদ ইত্যাদি বিখ্যাত উপন্যাসের জনক শওকত আলী সাহিত্যে তাঁর অবদানের জন্য ১৯৯০ সালে একুশে পদক অর্জন করেন।
কলেজজীবনেই তিনি কমিউনিস্ট দলের সঙ্গে সংযুক্ত হন, যার প্রভাব তাঁর উপন্যাসে ও গল্পে আমরা স্পষ্টই দেখতে পাই। তাঁর সৃষ্টি চরিত্রগুলোর কণ্ঠে শোনা যায় প্রান্তিক মানুষের স্বর। বসন্তদাস, লীলাবতী, ছায়াবতীরা এসেছে প্রান্তিক চরিত্রের রূপক হিসেবে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে খ্যাতির চূড়ায় ওঠেন শওকত আলী। ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’।
সেন রাজার শাসন থেকে স্খলিত হয়ে যাচ্ছে দেশ, তুর্কি আক্রমণ অত্যাসন্ন: ইতিহাসের সেই প্রদোষকালের জটিল আবর্তে ঘূর্ণয়মান কয়েকজন প্রাকৃত নরনারীর কাহিনী নিয়ে যে উপন্যাস, সেখানে আমাদের চেতনায় দাগ কাটে মিত্রানন্দের মতো চরিত্র, যে মানুষকে সপরিচয়ে উঠে দাঁড়াতে বলে, নতজানু দাসত্ব থেকে মুক্ত হতে বলে, আর এভাবেই সে আমাদের এত আপন হয়ে ওঠে !
প্রদোষে প্রাকৃতজন কেবল দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকের বাংলার জনজীবনের দিনপঞ্জি নয়, বরং শ্রেণিবিভক্ত বৈষম্য-পীড়িত, জনজীবনের করুণ বাস্তবতা উপলব্ধির এক সুবিশাল আধার। মৃৎশিল্পী হাটে-মাঠে-ঘাটে, গ্রামে-গঞ্জে, নদীতীরে, অরণ্যে নিরন্তর ছুটে-চলা শ্যামাঙ্গের জীবন, সামন্ত-মহাসামন্তদের দোর্দণ্ড প্রতাপ, কৈবর্তের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, চণ্ডালদের দ্রোহ, মৃৎ-রমণীদের জীবনের অনিশ্চয়তা, হাহাকার প্রভৃতির এক জীবন্ত কোলাজ হয়ে উঠেছে শওকত আলীর এ উপন্যাস।
এ উপন্যাসের সবচেয়ে বড় শক্তি ও দৌর্বল্যের বিষয় হলো এর ভাষা। যেখানে তিনি সাধু ভাষার শব্দভাণ্ডারকে বিস্ময়কর নৈপুণ্যে ব্যবহার করেছেন চলিত ভাষারগড়ন-সৌষ্ঠবে। তিনি ভাষার ব্যবহারে বিষয়ভিন্নতার তাৎপর্যকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছেন। ফলে প্রণয়ের ভাষা আর অত্যাচারী রাজকর্মচারীদের ভাষণ ভিন্ন না হয়ে পারেনি। অবশ্য এর একটি উল্টোপিঠও আছে, সেখানে চরিত্রগুলোর নিজস্ব কোনো ভাষা নেই। সব চরিত্রই কথা বলে লেখকের ভাষায়। ফলে একটি চরিত্রের হয়ে ওঠা—কথাসাহিত্যের এই মূলগত প্রত্যয় রক্ষিত হয়নি। প্রাচীন ভারতীয় ঋষিদের পাণ্ডিত্যের মতোই তাঁর শব্দভাণ্ডারের জগৎ। ফলত তাঁর বাক্যের গড়ন, অন্তর্বয়ন ও বক্তব্যের ধারাক্রম সহজ-সাবলীল ও অনিবার্য। প্রাচীন বাংলার বিচিত্র জনপদ, নদ-নদী, গ্রাম, শহর, তাঁর এই অসাধারণ সৃজনশীলতায় প্রাণময় হয়ে উঠেছে। এ ক্ষেত্রে ভাষার শক্তি, সামর্থ্য ও উৎপাদনশীলতাকে তিনি সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছেন।
সচেতন পাঠক সহজেই তাঁর কাব্যভাষার মাধুর্য ও আনন্দ নির্দ্বিধায় উপভোগ করতে পারেন। প্রকৃতপক্ষে এই ভাষা ব্যবহারই শওকত আলীকে স্বাতন্ত্র্য চিহ্নের দ্বারা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে তুলেছে।
আবহমান বাঙালি সমাজের একটি বিশেষ সময়ের সামাজিক বিনির্মাণের সূচনা পথের প্রতিচ্ছবি তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে এ উপন্যাসে ধারণ করেছেন। ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ তাই যেকোনো তাত্ত্বিক বিচারে দেড়শ' বছর ধরে বাংলা ভাষায় রচিত সেরা উপন্যাসগুলোর একটি।
এ কথা নিঃসন্দেহে স্বীকার্য যে শওকত আলীর মতো দমদার ঔপন্যাসিক বাংলা সাহিয়ত্যে বিরল। তাঁর এই অফুরন্ত শক্তির পরিচয় মেলে ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ ছাড়াও ‘নাঢ়াই’, ‘মাদারডাঙার কথা’, ‘দলিল’, ‘উত্তরের ক্ষেপ’ বা ‘ওয়ারিশ’-এর মতো উপন্যাসগুলোতে। ভবিষ্যতের পাঠকের কাছে প্রত্যাশা করি, তারা শওকত আলীকে পাঠ করবে আগ্রহে, আনন্দে ও নিজস্ব অন্তর্গত তাগিদ থেকে। তিনি বেঁচে থাকবেন আমাদের পাঠের ভেতরে।