এখনো প্রাসঙ্গিক আহমদ ছফার ‘গাভী বিত্তান্ত’
আহমদ ছফার ব্যঙ্গধর্মী উপন্যাস ‘গাভী বিত্তান্ত’। 'দেশের সবচাইতে প্রাচীন এবং সম্ভ্রান্ত বিশ্ববিদ্যালয়’ ও সেখানে নবনির্বাচিত একজন উপাচার্যের গাভীকে ঘিরে নানা ব্যঙ্গাত্মক বর্ণনা স্থান পেয়েছে উপন্যাসটিতে। তবে হাসির আড়ালে ঔপন্যাসিক পুরো বিশ্ববিদ্যালয়টির কদর্য চেহারাই তুলে ধরেছেন। এ যুগে এসেও গাভী বিত্তান্তে বর্ণিত বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রকৃত চেহারা একটুও বদলায়নি।
উপন্যাসে ‘গোটা দেশের আত্মা’ বলে খ্যাত, ‘গৌরবময় অতীত’ সমৃদ্ধ একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেট নির্বাচন নিয়ে নোংরা রাজনীতি, শিক্ষকদের অন্তর্দ্বন্দ্ব, সীমাহীন দুর্নীতি, কলহ, অনৈতিক দেন-দরবার, ছাত্র রাজনীতিকে হীন স্বার্থে ব্যবহার—এমন নানা বিষয় উঠে এসেছে। ঔপন্যাসিকের ভাষায় বললে, ‘অতীতের গরিমার ভার বইবার ক্ষমতা বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই। সাম্প্রতিককালে নানা রোগব্যাধি বিশ্ববিদ্যালয়টিকে কাবু করে ফেলেছে। মাছের পচন যেমন মস্তক থেকে শুরু হয়, তেমনি যাবতীয় অসুখের জীবাণু শিক্ষকদের চিন্তা-চেতনায় সুন্দরভাবে স্থান করে নিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্বরজারি, ধনুষ্টংকার নানা রকমের হিস্টিরিয়া ইত্যাকার নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাধিগুলো শিক্ষকদের ঘায়েল করেছে সবচাইতে বেশি। এখন শিক্ষক সমাজ বলতে কিছু নেই, আছে হলুদ, ডোরাকাটা, বেগুনি এসব দল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতা দখলের জন্য দলগুলো সম্ভব হলে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হতো। মাঠ এবং রাস্তা ছাত্ররা দখল করে রেখেছে বলে শিক্ষকদের লড়াইটা স্নায়ুতে আশ্রয় করে নিয়েছে।’
উপন্যাসের শুরুতে দেখা যায়, ঘটনাচক্রে দলাদলির ভেতর পড়ে গোবেচারা রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক মিয়া মোহাম্মদ আবু জুনায়েদ সেরা বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য পদে আসীন হন। পদের সঙ্গে সঙ্গে তার কাছে চলে আসে ক্ষমতা, আর ধীরে ধীরে তা পাল্টে ফেলতে থাকে আবু জুনায়েদকে। শ্বশুরের টাকায় লেখাপড়া শেখা আবু জুনায়েদ একসময় স্ত্রী নুরুন্নাহার বানুর অনুগত থাকলেও উপাচার্য হওয়ার পর তার বদলে যাওয়া পীড়া দিতে থাকে তার স্ত্রীকে। শিক্ষকদের দলাদলি, উপাচার্যকে নিয়ে ব্যঙ্গ করা, সহকর্মী দিলরুবা খানমের কাছে অপ্রত্যাশিত ব্যবহার, স্ত্রীর অত্যাচারসহ নানা সংকটে আবু জুনায়েদ বেশ বিড়ম্বনায় পড়লেও দ্রুতই সব সামলে উঠতে থাকেন।
নিজের সব দুর্বলতা চকচকে স্যুট-টাইয়ের আড়ালে চাপা দেওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা করতে থাকেন আবু জুনায়েদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের হাওয়া কোনদিকে বইছে, এসব বোঝার জন্য শুক্রবার মসজিদে গিয়ে জনসংযোগও করতেন। ধর্মীয় সংস্কারাচ্ছন্ন আবু জুনায়েদের এই কাজটা বেশ ভালোই ফল দেয়। এমনকি সরকারঘেঁষা এক কবি সম্মেলনে আবু জুনায়েদকে বক্তৃতায় বলতে শুনি, ‘কাজী নজরুল ইসলাম যদি দীর্ঘকাল সুস্থ থাকতে পারতেন, তিনিও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো নোবেল প্রাইজটি পেয়ে যেতেন। হিন্দুরা ষড়যন্ত্র করে নজরুলের মাথাটি খারাপ করে দিয়েছিল, তাই তাঁর ভাগ্যে নোবেল পুরস্কারটি জোটেনি।’
উপন্যাসের কাহিনী নতুন মোড় নিতে শুরু করে যখন আবু জুনায়েদের পরিচয় হয় ঠিকাদার শেখ তবারক আলীর সঙ্গে। আর তার সুবাদেই ভাগ্যের চাকাও দ্রুত ঘুরতে শুরু করে আবু জুনায়েদের। বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিবিরুদ্ধ এই সম্পর্ক আবু জুনায়েদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়াতে সাহায্য করে। আবু জুনায়েদের দীর্ঘদিনের শখ বাড়িতে গাভী পালবার, সেই শখও পূরণ হয় তবারক আলীর হাত ধরে। উপাচার্য ভবনের আঙিনায় বিলাসবহুল গোয়ালঘর তৈরি করে ‘সুইডিশ গাভী এবং অস্ট্রেলিয়ান ষাঁড়ের মধ্যে ক্রস ঘটিয়ে’ জন্মানো দুর্লভ গাভী ‘তরণী’কে রাখা হয় সেখানে। এই গাভীকে কেন্দ্র করে উপাচার্যের নতুন জীবন আবর্তিত হতে শুরু করে। নানা কারণে গাভীটিকে তিনি সৌভাগ্যের প্রতীক ভাবতে শুরু করেন। গাভীর প্রতি আবু জুনায়েদের বাড়াবাড়ি রকমের ভালোবাসা স্ত্রীর কাছে চক্ষুশূল হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়কেই আবু জুনায়েদ তার গোয়ালঘরে ঢুকিয়ে ফেলেন।
আহমদ ছফা এ নিয়ে একটা দারুণ বর্ণনাও দিয়েছেন, ‘মোগল সম্রাটেরা যেমন যেখানে যেতেন রাজধানী দিল্লিকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন, তেমনি আবু জুনায়েদও দিনে একবেলার জন্য গোটা বিশ্ববিদ্যালয়কে গোয়ালঘরে ঢুকিয়ে ফেলতেন। দিনে দিনে গোয়ালঘরটাই বিশ্ববিদ্যালয়ের হৃৎপিণ্ড হয়ে উঠল। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে এটাই পৃথিবীর একমাত্র গোয়ালঘর, যেখান থেকে আস্ত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মপদ্ধতি পরিচালিত হয়।’
আবু জুনায়েদের কাছে গাভীটাই ধ্যান-জ্ঞান হয়ে উঠল। এমনকি রসায়ন বিভাগের শিক্ষক মুস্তাফিজুর রহমান রসায়নে বিশ্বকাঁপানো ব্রেক-থ্রু রিসার্চ করলেও গাভীর চিন্তায় ব্যস্ত আবু জুনায়েদের তা দেখার সময় মেলেনি। সেই অবলা গাভীকে সতিন-জ্ঞান করে আবু জুনায়েদের স্ত্রী বানু বিষ খাইয়ে মেরে ফেললেন। শোকে কাতর আবু জুনায়েদ যেন দিশা হারিয়ে ফেললেন। যে জীবিত গাভীকে আবু জুনায়েদ সৌভাগ্য-জ্ঞান করেছিলেন, মরেও সেই গাভী সৌভাগ্যের আরেক দ্বার খুলে দিয়ে গেল যেন। পশ্চিমা দেশের রাষ্ট্রদূত জুনায়েদ সাহেবের গাভীপ্রেমে মুগ্ধই হয়েছিলেন বোধ হয়। অচিরেই আমেরিকার ৫১টি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচার দেবার ডাক আসে তার। সঙ্গে বিরাশি লক্ষ টাকার হাতছানি। তবে এই খুশির মধ্যেই আবু জুনায়েদ জানতে পারেন, তার প্রিয় গাভীটিকে খুন করেছেন তারই স্ত্রী। এখানেই উপন্যাসের কাহিনী সমাপ্ত হয়।
জ্ঞানচর্চার নামে আমাদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যা হয়, তার একটা নমুনা হিসেবে এই উপন্যাস আজও প্রাসঙ্গিক বলেই মনে হবে খোঁজ-খবর রাখা পাঠকদের। উপন্যাসের চরিত্রগুলোর নামগুলোর আড়ালে সত্যিকার অনেক চরিত্রই উঠে এসেছে, অনেক পাঠকই তা ধরতে পারবেন। ধরতে পারবেন আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কী চলছে? বইটা পড়তে পারেন।