জমির মালিকানা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিটবাসী
স্থলসীমান্ত চুক্তি অনুযায়ী ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশি ৫১টি ছিটমহলের প্রায় সাত হাজার একর জমি পাচ্ছে ভারত সরকার। তবে এই জমিগুলো এখনো বাংলাদেশের বিভিন্ন ভূমি কার্যালয়ের আওতায়। আর এগুলো নিবন্ধন করা হয়েছিল এসব এলাকার কোনো না কোনো সাব-রেজিস্ট্রি কার্যালয়ে। ফলে বাংলাদেশি নিবন্ধনকৃত এসব দলিলই এখন একমাত্র প্রমাণপত্র প্রতিবেশী দেশটির অভ্যন্তরে থাকা ছিটমহলবাসীদের, যারা প্রায় সবাই নিতে যাচ্ছে ভারতীয় নাগরিকত্ব।
এখন এসব মানুষের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে-‘জমি ভারত পাচ্ছে, আমরাও ভারতেই থেকে যাব। কিন্তু আমাদের ব্যক্তি মালিকানায় থাকা জমি কীভাবে বাংলাদেশের ভূমি কার্যালয়ের পরিবর্তে ভারতের আওতায় আসবে?’
আবার দেশের মূল ভুখণ্ডে আসতে না পেরে সাদা কাগজে নিজেরাই লেখালেখি করে জমি কেনাবেচা করেছে ছিটমহলের বাসিন্দারা। এভাবে হাতবদল হয়েছে কয়েকবার। ফলে এসব মানুষ এখন দুশ্চিন্তা করছে। তাদের প্রশ্ন, জমির মালিকানা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন আগে দলিল করা জমির দলিলকেই মূল হিসেবে ধরে মালিকানা পরিবর্তন করা হবে নাকি যেকোনো কাগজে লেখা এবং দখলসত্ত্বকে প্রাধান্য দেওয়া হবে?
দীর্ঘ ‘বন্দিত্ব’ থেকে মুক্তির স্বাদ পেতে যাওয়া এসব মানুষের সামনে এখন জমির বিষয়টি মূল সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বিভিন্ন বাংলাদেশি ছিটমহল ঘুরে জানা গেছে এ তথ্য। এ সমস্যা সমাধানে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছে বাংলাদেশি ছিটমহলের বাসিন্দারা।
ছিটমহলবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশি যে ৫১টি ছিটমহলের এসব জমি রয়েছে লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী ও পঞ্চগড় জেলার বিভিন্ন ভূমি কার্যালয়ের আওতায়। এসব জমি কেনাবেচা বা খারিজের মতো কাজ করতে একসময় ভারতের অভ্যন্তরে থাকা ছিটমহলবাসী সীমান্ত পেরিয়ে আসত বাংলাদেশে। কিন্তু পরবর্তীকালে সীমান্তে কাঁটাতার ও কড়াকড়ি আরোপের ফলে এসব মানুষ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে। এই বাস্তবতায় চোরাই পথে বাংলাদেশের নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প নিয়ে গিয়ে কিংবা নিজেরাই সাদা কাগজে লেখালেখি করে জমি কেনাবেচা করত খারিজ-রেজিস্ট্রি ছাড়াই। এভাবেই যুগের পর যুগ ধরে সেখানে হয়েছে জমির ব্যক্তিমালিকানার পরিবর্তন।
হয়তো বাংলাদেশের ভূমি কার্যালয়ে জমি রয়েছে একজনের নামে কিন্তু বাস্তবে সেখানে এর মালিকানা পরিবর্তন হয়ে জমি কিনে মালিক হয়েছেন অন্য কেউ। ফলে নিবন্ধন ছাড়াই যারা জমি কিনেছে, তারা এখন দুশ্চিন্তায় পড়েছে।
সরকার যদি জমির পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে থাকা তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে মালিকানা পরিবর্তন করে দেয়, তাহলে যারা এতদিন ধরে জমি কিনে ভোগদখল করছে, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে জানালেন কোচবিহার জেলার দিনহাটা মহকুমার ভেতরে থাকা কাজিরহাট বাত্রিগাছ ছিটমহলের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম সরকার (৫২)। তিনি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমরা লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের আওতায় থাকা ছিটবাসী। তাই এখানকার জমিগুলো আদিতমারী ভূমি কার্যালয়ের আওতায় রয়েছে। তবে ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমে আমরা ভারতেই থেকে যাব। সে ক্ষেত্রে জমির মালিকানা পরিবর্তন নিয়ে আমরা রয়েছি দুশ্চিন্তায়।’
একই ছিটমহলের আরেক বাসিন্দা আবুল হোসেন সরকার বলেন, ‘জমিগুলো যাদের নামে রেকর্ড করা আছে, সেসব মালিকের কাছে এখন সেই জমি নেই। হয়তো কেনাবেচা হয়ে এর মালিক হয়েছে অন্য কেউ।’
কিসামত বাত্রিগাছ ছিটমহলের বাসিন্দা অনিল চন্দ্র বর্মণ বলেন, ‘সীমান্তের কড়াকড়ির কারণে আমরা বাংলাদেশে গিয়ে জমি নিবন্ধনের মাধ্যমে কেনাবেচা করতে পারিনি। তাই বাধ্য হয়ে স্ট্যাম্পে বা সাদা কাগজে নিজেরাই লেখালেখি করে জমি কেনাবেচা করে আসছি এতদিন ধরে।’
এই বাস্তবতায় প্রতিবেশী দেশটির অভ্যন্তরে থাকা মানুষগুলো বলছে, তারা যেহেতু ভারতীয় নাগরিকত্ব নিতে যাচ্ছে, তাই এখন তাদের সামনে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের ব্যক্তি মালিকানার জমিজমা নিয়ে। তাই তারা চাচ্ছে, দুই দেশের সরকার যৌথভাবে নতুন করে এসব জমি রেকর্ড করে মালিকানা ঠিক করে দিক।
কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী উপজেলার আওতায় ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশি পোয়াতুরকুটি ছিটমহলের কৃষক আবু বক্কর হোসেন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমরা চাই জমিটা নতুন করে রেকর্ড করুক এবং তা হোক ভারতীয় সরকারের মাধ্যমে।’
মধ্য মশালডাঙ্গা ছিটমহলের নওশের আলী বলেন, ‘এটা ঠিক ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা পাচ্ছি। কিন্তু জমির জটিলতা নিয়ে আমার এখন অনেক চিন্তিত। তাই আমাদের দিকে চেয়ে নরেন্দ্র মোদি এবং শেখ হাসিনা যেন বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন সে অনুরোধ জানাচ্ছি।’
নীলফামারী জেলার আওতায় এবং ভারতের কুচলিবাড়ি থানার অভ্যন্তরে থাকা বালাপুকুরি ছিটমহলের বাসিন্দা গোবিন্দ অধিকারী বলেন, ‘ছিটমহল বিনিময়ে যেমন দুই দেশ সমঝোতার মাধ্যমে জমি পাচ্ছে তেমনি আমরাই চাই সঠিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই যেন আমাদের জমির মালিকানা পরিবর্তন হোক কোনো জটিলতা ছাড়াই।’
শুধু তাঁরাই নন, প্রতিবেশী ভারতের অভ্যন্তরে থাকা ছিট করলা, পশ্চিম মশালডাঙ্গা, বাকালিছড়াসহ অন্যান্য ছিটমহলের বাসিন্দারাও দাবি জানিয়েছেন জমি জটিলতার বিষয়টি যেন ঢাকায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে দুই প্রধানমন্ত্রী গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করেন।