ঐশীর মৃত্যুদণ্ড সমস্যার সমাধান নয়
পুলিশ দম্পতিকে খুনের ঘটনায় তাদের একমাত্র কন্যা ঐশীকে আজ মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন বিজ্ঞ আদালত। হত্যাকাণ্ডের ২৭ মাসের মাথায় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল এ রায় দিলেন।
একই ঘটনায় ঐশীর বন্ধু রনিকে দুই বছরের কারাদণ্ডাদেশ আর জনিকে খালাশ দিয়েছেন আদালত।
এসব বিষয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই। খুনের সময় ঐশী প্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন বলেই ঐশীর বিরুদ্ধে এই রায় দিয়েছেন আদালত। নতুবা হয়তো তাঁকে শিশু সংশোধনাগারে পাঠানো হতো।
যেমনটি চলছে তার গৃহকর্মী খাদিজা আক্তার সুমির ক্ষেত্রে। গত বছরের ১ জুন সে তার মায়ের জিম্মায় জামিনে মুক্ত আছে।
২০১৩ সালের ১৬ আগস্ট পুলিশের বিশেষ শাখার (রাজনৈতিক শাখা) পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান এবং তাঁর স্ত্রী স্বপ্না রহমান রাজধানীর চামেলীবাগের নিজ বাসায় খুন হন।
১৭ আগস্ট থানায় অজ্ঞাতদের আসামি করে মামলা দায়ের করেন নিহতের ছোট ভাই মশিহুর রহমান। পুলিশ ঐশীকে সন্দেহের তালিকায় রাখার কথা বললেও বাদী তা অবিশ্বাস করেন বলেই গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন।
কিন্তু একই দিন বিকেলে ঘটনার চিত্র দেশবাসীর কাছে মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে গেল। ঐশী নিজেই থানায় আত্মসমর্পণ করে ঘটনার বিবরণ দিলেন।
ঐশী তাঁর জবানবন্দিতে মা-বাবার সাথে মনোমালিন্যের কথা জানান। বিশেষ করে তিনি তাঁর মায়ের দিকে অভিযোগের তীর বেশি নিক্ষেপ করেন।
মা-বাবা তাঁকে বাইরে যেতে দিতেন না। দারোয়ানের প্রতি নির্দেশ ছিল তাঁকে যেন বাইরে বেরোতে না দেওয়া হয়। একই অনুরোধ ছিল বাড়িওয়ালার কাছেও।
এখান থেকেই আদালতসহ দেশের বিবেকবান মানুষের নিকট আমার প্রশ্ন শুরু। কেন ঐশীকে বাইরে যেতে দেওয়া হতো না? কেন তাঁর ওপর এত কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছিল?
সবাই এর জবাবে বলবেন- মেয়েটি ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন। বন্ধুদের সঙ্গে যাচ্ছেতাইভাবে ঘুরে বেড়াতেন। ছেলেদের সাথে যা-তা করে বেড়াতেন। নাইটক্লাবে গিয়ে ড্যান্স করতেন। সিসা টানতেন। অনেক রাত করে ঘরে ফেরতেন-ইত্যাদি।
আপাতদৃষ্টিতে সন্তানের প্রতি মা-বাবার এমন দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক বলেই মনে হয়। তা তাঁরা তাঁদের মেয়ের সংশোধন চেয়েছেন। প্রত্যেক মা-বাবাই চান তাঁদের সন্তানরা সুষ্ঠুভাবে বেড়ে উঠুক। যা ঐশীর ক্ষেত্রে হয়ে ওঠেনি। ঐশী ইতিমধ্যেই মাদকাশক্ত হয়ে পড়েছিলেন। কথাগুলো আমার নয়। খোদ তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তারাই বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমকে এসব কথা জানিয়েছিলেন।
আচ্ছা কিছু প্রশ্ন করা যাক। খুনের সময় ঐশীর বয়স কত হয়েছিল? বড় জোড় ১৮। আর একটা শিক্ষার্থীকে মাদকাসক্ত হতে কতদিন সময় লাগে? দু-চারদিন নিশ্চয় নয়।
আচ্ছা তিনি যাঁদের সঙ্গে মিশতেন তাঁরা কেমন ঘরের সন্তান ছিল? নিশ্চয় সমাজের সভ্য শ্রেণির দাবিদার প্রথম শ্রেণির মা-বাবার সন্তানদের সাথেই।
আচ্ছা তিনি তো ইয়াবা-সিসা খেতেন, রাত-বিরাতে যেখানে-সেখানে যেতেন। এর জন্য তো অনেক টাকার প্রয়োজন হতো, তাই না? এসব টাকা কোত্থেকে পেতেন? নিশ্চিত পুলিশ কর্মকর্তার পকেট থেকেই। আর এ টাকার পরিমাণ যে নেহাত কম ছিল না, তা কিন্তু সত্য।
আমার ছোট্ট মাথায় যে পরিমাণ টাকার হিসাব আসছে তাতে দৈনন্দিন এক হাজার টাকার কম হওয়ার কথা নয়। কারণ একজন ইয়াবা আসক্ত মানুষ প্রতিদিন ন্যূনতম একাধিক ইয়াবা সেবন করে। আর প্রতিটি ইয়াবা নিশ্চয় মার্কেটে ৩০০ টাকার কমে বিক্রি হচ্ছে না। তাহলে? অন্যান্য খরচ বাদই থাক। এ হিসাবে হয়তো প্রতি মাসে ঐশীর প্রয়োজন হতো কমপক্ষে ৩০ হাজার টাকা। এসব টাকা কোথা থেকে আসত? এসব টাকার উৎস কী ছিল?
অবশ্য এসব টাকার উৎসের কিছুটা তার বন্ধুদের পকেটও হতে পারে।
সমস্যাগুলো একে একে পুলিশ দম্পতির নজরে আসে, কিন্তু তখন সমস্যা আর প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল না। সমস্যার শিকড় অনেক গভীরে চলে যায়।এখানেই আমাদের অনেক মা-বাবার সমস্যা। তাঁরা তাঁদের সন্তানদের প্রতি বেখেয়াল হয়ে যান। হয়তো ঐশীর ক্ষেত্রেও এটাই হয়েছিল। নতুবা একটি কিশোরী তো দূরের কথা, একটি কিশোরেরও সহসা এমন সমস্যায় জড়িয়ে যাওয়ার কথা নয়। কারণ এটি দু-চারদিনের প্রেক্ষাপট নয়।
এবার আসা যাক ঐশীর খুন করার প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে। আদালতের অভিযোগপত্র হতে জানা যায়, তিনি কফির সঙ্গে ৬০টি ঘুমের বড়ি মিশিয়ে তার মা-বাবাকে খাওয়ান। তারপর মাকে ১১টি কোপ দেন। সাথে বাবাকেও।
ঐশী এসব শিখেছেন কোথা থেকে? আপনারা অনেকেই বলবেন এটা তো সাধারণ জ্ঞানের কথা। যেকোনো মানুষই এটা জানে। আমি বলব না। এর পেছনেও রয়েছে আমাদের শিক্ষা-ব্যবস্থার দুর্বলতা। কারণ শিশু তার জন্মের পর তাই প্রয়োগ করে যা সে শেখে। এসব পাঠ্যবই হতে না শেখা গেলেও আমাদের নাটক-সিনেমায়ও যে অহরহ দেখানো হচ্ছে। পত্র-পত্রিকায় লেখা হচ্ছে। এগুলো হতে একটি শিশু শেখে এবং তা প্রয়োগে আগ্রহী হয়ে ওঠে। অথবা প্রয়োজনে তা প্রয়োগ করে থাকে।
ঐশীর পারিবারিক বন্ধন খুঁজে দেখা দরকার। কারণ পারিবারিক অশান্তি থাকলে সন্তানরা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। মা-বাবার প্রতি ভালোবাসা হারিয়ে ফেলে। হয়তো ঐশীদের পরিবারে এমনটি ঘটে থাকতে পারে। তিনি একাকিত্ব অনুভব করতেন। পরিবারের সদস্যদের সাথে মিশে শান্তি পেতেন না।
মাননীয় বিচারক, আপনি এ হত্যাকাণ্ডের রায় দিয়েছেন। এতে আমার কোনো আপত্তি নেই্। তবে একটি বড় জোর অনুরোধ রয়েছে। এ অনুরোধ শুধু আপনার কাছে নয়। গোটা সমাজ ব্যবস্থার কাছে। সরকারের কাছে। সব নীতিনির্ধারকের কাছে।
আপনারা মূলে আঘাত করুণ। সংস্কার করুন। সমস্যর আমূল পরিবর্তন করুন।
কারণ আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, স্বাভাবিক একটি ঐশীকে হন্তারক ঐশীতে রূপান্তর করেছে মূলত মাদক। কারণ মাদকাসক্ত ব্যক্তির বিবেকবোধ, ভালোমন্দ যাচাইয়ের কোনো শক্তি থাকে না।
আপনারা মাদকের সব আড্ডাখানার দিকে নজরদারি বাড়ান। মাদকের প্রকৃত হর্তা-কর্তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসুন। সব স্তরের মানুষের মাঝে কাউন্সেলিং বাড়ান। মাদক উৎপাদন বন্ধ করুন।
বিশেষ করে তরুণ সমাজসহ শিক্ষার্থীদের মাঝে মাদক একটা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে।
সর্বশেষ বলতে চাই। ঐশী জন্ম থেকে হন্তারক ছিলেন না। সে অপরাধের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পেছনে তাঁর পরিবার দায়ী। গোটা সমাজ দায়ী। এখন আর একান্নবর্তী পরিবার নেই। সন্তানরা একা একা ঘরে সময় কাটায়। এ সময় তাদের সঙ্গী হয় পরিবারের সদস্যদের ভালোবাসার পরিবর্তে অন্য কিছু। যেগুলোর মধ্যে প্রবেশ করে অনেক নেতিবাচক দিক।
শিশুরাও সামাজিক জীব। তাই তারা বাইরে থাকতে চায়। এই মেশাই হয় অনেকের জন্য ক্ষতির কারণ।
দয়া করে ঐশীকে ফাঁসি দিয়ে নয়। আসল সমস্যায় আঘাত করুন। একজন ঐশীকে পৃথিবী হতে বিদায়ের চেয়ে কি হাজারো হন্তারক ঐশী জন্মের পথগুলো বন্ধ করা উত্তম নয়?
ঐশীদের স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে দিন। হত্যার প্রতিশোধ হত্যা দিয়ে হলেও, হত্যার পথ হত্যা দিয়ে বন্ধ হয় না।
লেখক : উন্নয়নকর্মী।