অবশেষে ভোটার তালিকায় নাম সন্তু লারমার
গেরিলা জীবনের সমাপ্তি হয়েছে তাঁর বহু আগেই। ১৯৭৬ সালে বড় ভাইয়ের হাত ধরে সংগঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র শাখা ‘শান্তিবাহিনী’তে যোগ দেন। ১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর ভ্রাতৃঘাতী সশস্ত্র হামলায় ভাই মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার মৃত্যুর পর তিনিই হাল ধরেছিলেন সংগঠনের। বহু রক্তপাত আর দীর্ঘ ২১ বছরের সশস্ত্র লড়াই শেষে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর প্রায় দুই হাজার সশস্ত্র সহযোদ্ধাসহ অস্ত্র সমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন তিনি।
চুক্তি স্বাক্ষরের পর গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান এবং এখনও প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদায় সেই দায়িত্বেই বহাল আছেন। তিনি পাহাড়িদের প্রধান আঞ্চলিক দল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা সন্তু।
তবে মজার ব্যাপার হলো, গত ২৪ বছরেও ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত কিংবা জাতীয় পরিচয়পত্র গ্রহণ করেননি সন্তু লারমা। জাতীয় বা আঞ্চলিক কোনো নির্বাচনে দেননি ভোটও। স্থানীয়ভাবে জাতীয় কোনো কর্মসূচিতেও অংশ নেননি। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলেও এড়িয়ে গেছেন।
সন্তু লারমার দলের নেতাদের দাবি, পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে পৃথক ভোটার তালিকার দাবি বাস্তবায়িত না হওয়ার প্রতিবাদেই ‘ভোটার হননি’ এবং ‘জাতীয় পরিচয়পত্র গ্রহণ’ করেননি সন্তু লারমা।
১৯৯৭ সালে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার পর ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচন বর্জন করে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি। কিন্তু এরপরের জাতীয় নির্বাচন এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনে স্বতন্ত্র পরিচয়ে অংশগ্রহণ করে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন না পাওয়া দলটির প্রার্থীরা। এদের মধ্যে ২০১৪ সালে ‘স্বতন্ত্র’ পরিচয়ে রাঙামাটির সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন জনসংহতির প্রার্থী সহসভাপতি ঊষাতন তালুকদার। ঊষাতন ২০০৯ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে পরাজিত হয়েছিলেন। এর বাইরে গত এক দশকে একাধিকবার রাঙামাটির বেশিরভাগ উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েছে জনসংহতি সমর্থিত প্রার্থীরা। কিন্তু নিজে ভোটার না হওয়ার এসব প্রার্থীদের কাউকেই কখনই ভোট দিতে পারেননি দলের শীর্ষ নেতা সন্তু লারমা।
বহুদিন পর ভোটার তালিকায় নাম লিখিয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা সন্তু। এবার নিজের প্রয়োজনেই জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্য আবেদন করলেন পাহাড়ের প্রভাবশালী এই নেতা। কোভিড টিকা নেওয়ার জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক করায় তাঁর হাতে অন্য কোনো উপায়ই ছিল না। এ ছাড়া যেহেতু জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়ার প্রধান শর্ত অনুযায়ী ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করতে হয়, সেহেতু ভোটার তালিকায় নাম লিখিয়েছেন তিনি। এরপর জাতীয় পরিচয়পত্রও পাবেন তিনি।
রাঙামাটি জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. শফিকুর রহমান জানিয়েছেন, নিয়ম অনুযায়ী তিনি (সন্তু লারমা) ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করার আবেদন করেছেন এবং আমরা করেছি। সে অনুযায়ী তিনি জাতীয় পরিচয়পত্রও পাবেন। আগস্ট মাসের ২৯ তারিখ তিনি ভোটার হয়েছেন।’
এদিকে, স্বাস্থ্য বিভাগের একটি দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে, মূলত কোভিড-১৯ এর টিকা নেওয়ার জন্যই বাধ্যতামূলক করা জাতীয় পরিচয়পত্র নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না তাঁর। তাই ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন জাতীয় পরিচয়পত্র পেতে এবং এজন্য জেলা নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে গিয়ে ছবি তোলার কাজও সম্পন্ন করেছেন। সার্ভার থেকে নেওয়া অস্থায়ী জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে ইতোমধ্যেই কোভিড-১৯ এর টিকাও নিয়েছেন তিনি।
সন্তু লারমার কোভিড-১৯ এর টিকার দুটি ডোজই নেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রাঙামাটির সিভিল সার্জন ডা. বিপাশ খীসা।
তবে এই বিষয়ে কথা বলার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি সন্তু লারমার সঙ্গে। তাঁর দল জনসংহতি সমিতির মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত নেতাদের কাউকেও পাওয়া যায়নি বক্তব্য জানতে।
১৯৪৪ সালে জন্ম নেয়া জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা সন্তুর বাবার নাম চিত্ত কিশোর চাকমা এবং মা সুভাষিনী দেওয়ান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন।