প্রতিক্রিয়া
জিহাদের মৃত্যু : একটি দৃষ্টান্তমূলক রায়
বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় এটি একটি অনন্য এবং দৃষ্টান্তমূলক রায়। এটি ভবিষ্যতে উদাহরণ হয়ে থাকবে এবং দায়িত্বে অবহেলা সম্পর্কিত কোনো ঘটনা আদালত পর্যন্ত গড়ালে এই রায় রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহৃত হবে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজে জবাবদিহি প্রতিষ্ঠায় এ রায় একটি বড় ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।
রাজধানীর শাহজাহানপুরে নলকূপের পাইপে পড়ে শিশু জিহাদের মৃত্যুর মামলায় রোববার ঢাকার বিশেষ জজ আদালত যে রায় দিয়েছেন, সেখানে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স এসআর হাউসের মালিক মো. শফিকুল ইসলাম ওরফে আবদুস সালাম, রেলওয়ের সিনিয়র সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার (নলকূপ পরিদর্শন) মো. জাহাঙ্গীর আলম, কমলাপুর রেলওয়ের সহকারী প্রকৌশলী মো. নাসির উদ্দিন ও ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার জাফর আহমেদ শাকিকে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। বেকসুর খালাস পেয়েছেন কমলাপুর রেলওয়ের সহকারী প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) দীপক কুমার ভৌমিক ও সহকারী প্রকৌশলী-২ মো. সাইফুল ইসলাম।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, সংশ্লিষ্টদের চরম দায়িত্বে অবহেলার কারণেই শিশু জিহাদের অকালমৃত্যু হয়েছে। অর্থাৎ শিশু জিহাদের মৃত্যুর জন্য আসামিরা সরাসরি দায়ী না থাকলেও তাদের পরোক্ষ দায় বা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনে ব্যর্থতার কারণে তাদের সাজা দেওয়া হয়েছে; দেশের বিচারিক ইতিহাসে যার দৃষ্টান্ত বিরল।
দেশবাসীর মনে আছে, ২০১৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর বিকেল ৩টার দিকে উন্মুক্ত অবস্থায় থাকা নলকূপের পাশে খেলতে খেলতে পাইপের ভেতর পড়ে যায় শিশু জিহাদ। গণমাধ্যমে এই খবর ছড়িয়ে পড়লে দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। রাতভর লাইভ বা সরাসরি সম্প্রচার করে সংবাদভিত্তিক টেলিভিশনগুলো। মনে আছে, ঘটনার পর থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত টানা প্রায় ২০ ঘণ্টা আমি নিউজরুমে ছিলাম। শিশু জিহাদের উদ্ধার তৎপরতার খবর প্রতিমুহূর্তে দেশবাসীকে জানানোর দায়বদ্ধতার প্রশ্নে আমাদের সহকর্মীদের আন্তরিকতা আর তাকে জীবিত উদ্ধারে পুরো দেশের মানুষ যেভাবে তার জন্য প্রার্থনা করেছে বলে বিভিন্ন স্থান থেকে আমরা খবর পেয়েছি, তা সত্যিই বিরল। যদিও শেষমেশ তাকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ওই ঘটনার পরে জিহাদের বাবা নাসির ফকির বাদী হয়ে অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ এনে থানায় মামলা করেন।
প্রত্যক্ষভাবে অপরাধে জড়িত থাকার পরও যে দেশে সাক্ষী-প্রমাণের অভাবে বা নানা কারণে আসামিরা ছাড়া পেয়ে যায়, বুক ফুলিয়ে হাঁটে, সেখানে একজন শিশুর মৃত্যুর জন্য তিনজন সরকারি কর্মকর্তা এবং একজন ঠিকাদারকে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়ার এ ঘটনা দেশের বিচার বিভাগের জন্য তো বটেই, দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার পথেও একটি বড় পদক্ষেপ। কারণ, ভবিষ্যতে এ রকম কোনো প্রতিষ্ঠানের অবহেলার কারণে কোনো নাগরিকের প্রাণ গেলে বা ক্ষতি হলে তারও বিচার হবে বলে আশা করা যায়। আমরা স্মরণ করতে পারি, গত বছরের মার্চে রাজধানীর মগবাজার ফ্লাইওভারে কর্মরত অবস্থায় এক শ্রমিকের মাথায় লোহার টুকরা পড়ে মৃত্যুর কথা। সেই মৃত্যুর দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারে না ফ্লাইওভার নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান এবং সরকার।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) ২০১৫ সালের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ওই বছর দেশের বিভিন্ন স্থানে ৩৬৩ শ্রমিক মারা গেছেন। এর মধ্যে নির্মাণ খাতে কর্মরত শ্রমিক নিহত হয়েছেন ৬১ জন। প্রতিবেদনে বলা হয়, সচেতনতা ও কর্মস্থলের নিরাপত্তাহীনতার কারণে ২০১৫ সালে কাজ করতে গিয়ে সারা দেশে বিভিন্ন খাতে কর্মরত অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে ৩৬৩ জন শ্রমিকের। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক মারা গেছেন পরিবহন খাতে, ১২৫ জন। এ ছাড়া কর্মস্থলে গত বছর আহত হয়েছে ৩৮২ জন।
অনুসন্ধানে দেখা যাবে, এসব মৃত্যুর অধিকাংশের জন্যই দায়ী কর্তৃপক্ষের অবহেলা। সরকারের এত এত প্রতিষ্ঠান এত এত কর্মকর্তা-কর্মচারী; কিন্তু তাঁরা নিজেদের বেতন-ভাতা, ছুটিছাটা নিয়ে এত বেশি ব্যস্ত থাকেন যে কোথায় ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে আছে, কোথায় পাইপের মুখ খোলা, কোথায় সেতুর নাটবোল্ট ঢিলা, কোথায় গ্যাসলাইনের পাইপে ছিদ্র—এসব দেখার সময় নেই। অভিযোগ করলেও অনেক সময় প্রতিকার মেলে না।
শিশু জিহাদের মৃত্যুর জন্য যেভাবে সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব অবহেলাকে দায়ী করে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, একইভাবে যদি রাষ্ট্রের প্রতিটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের অবহেলার চিত্র এবং তার ফলে মৃত্যু ও দুর্ঘটনার খতিয়ান বের করা হয়, অত্যন্ত ভয়াবহ চিত্র ফুঠে উঠবে। বছরের পর বছর চলে আসছে এই অনিয়ম, এই অবহেলা। মানুষের জীবনের কোনো মূল্য নেই জনগণের করের পয়সা বেতন পাওয়া সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। হাতেগোনা কিছু লোক বাদ দিলে অধিকাংশেরই জনগণের প্রতি কোনো কমিটমেন্ট আছে বলে মনে হয় না। আমাদের চারপাশে তাকালেই সেই করুণ বাস্তবতা আমরা দেখতে পাই।
সুতরাং জিহাদের মৃত্যুর জন্য দায়ী করে যেভাবে সংশ্লিষ্টদের সাজা দেওয়া হলো, সেটি থেকে শিক্ষা নিয়ে সরকারের সব প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে বিভিন্ন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান নিজেদের দায়িত্বের ব্যাপারে সচেতন হবে, শুধু বেতন-ভাতা, ছুটিছাটার পেছনে ব্যস্ত না থেকে জনগণের পয়সা হালাল করে খাবে—এ প্রত্যাশা দেশের প্রত্যেক নাগরিকের।
আমীন আল রশীদ : সাংবাদিক ও লেখক।