অভিমত
‘ছিলে দেবী, হলে দাসী’
‘শান্তি’ ও ‘শাস্তি’ শব্দ দুটির মধ্যে পার্থক্য কেবল একটি ‘স’-এ। ‘স’ দিয়েই লেখা হয় সু চি। আরেক ‘শ’ দিয়ে লেখা হয় শান্তি, যার জন্য নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল সু চিকে। কিন্তু তিনি সেই পুরস্কারের মর্যাদা হারিয়েছেন এরই মধ্যে। বরং এখন তাঁর শাস্তির দাবি উঠেছে। তাঁর নোবেল কেড়ে নেওয়ার দাবিও জোরালো হচ্ছে। ‘স’ দিয়ে লেখা হয় যে সংখ্যালঘু, তাদের মানবাধিকার রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছেন শান্তির দেবী। তিনি এখন আরেক ‘স’ দিয়ে লিখিত সেনাবাহিনীর তোতাপাখি।
‘স্ববিরোধিতা’ শব্দটিও লেখা হয় ‘স’ দিয়ে; যা আমরা প্রতিনিয়তই দেখছি মিয়ানমার সরকারের কথাবার্তায়। ১৯ সেপ্টেম্বর দেশটির উপদেষ্টা অং সান সু চি তাঁর ভাষণে যে স্ববিরোধিতার উদাহরণ দিয়েছেন, তার সঙ্গেই সুর মিলিয়েছেন দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্ট হেনরি ভ্যান থিও। সেনাবাহিনীর জাতিগত নির্মূল অভিযানের মুখে লাখো রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে এলেও জাতিসংঘে দেওয়া ভাষণে মি. হেনরি বলেন, মুসলিমদের পালিয়ে যাওয়ায় তারা উদ্বিগ্ন। ব্যাপারটা এমন যে, কেউ একজন আমার হাত কেটে নেওয়ার পর জিজ্ঞেস করল,আপনি কাঁদছেন কেন? কদিন আগেও দেশেটির সেনাপ্রধান স্পষ্টই বলেছেন যে, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নয় এবং এই ইস্যুতে তিনি সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। সেই মুহূর্তে ভাইস প্রেসিডেন্টের এই বক্তব্য নির্মম রসিকতা ছাড়া কিছুই নয়।
এই নির্মম রসিকতা আমরা সু চির কাছ থেকেও পেয়েছি। তিনি যে সেনাবাহিনীর লিখে দেওয়া বক্তব্যেরই একজন নিছক পাঠক ছিলেন, সে বিষয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই। যে সেনাবাহিনী তাঁকে বছরের পর বছর গৃহবন্দি করে রেখেছিল, যাদের হাত থেকে দেশ ও গণতন্ত্রকে মুক্তির সংগ্রাম করেছিলেন এবং যে সংগ্রামের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন, সেই সেনাবাহিনীর জেনোসাইডকেই তিনি এখন বৈধতা দিচ্ছেন। ক্ষমতার মোহ যে কী ভয়ংকর জিনিস, তা আরো একবার বিশ্ববাসী দেখল সু চির কল্যাণে। সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী একটি টেলিভিশন টকশোতে রবীন্দ্রনাথের ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন,‘যত হাসো আজ, যত করো সাজ, ছিলে দেবী, হলে দাসী’। সূচি সম্পর্কে সম্ভবত এর চেয়ে শক্তিশালী মন্তব্য এখন অবধি কেউ করেননি।
প্রশ্ন উঠছে, রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান কোথায়? জাতিসংঘ, আসিয়ান, বিমসটেক নাকি চীন ও ভারতের হাতে? ‘ রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক চাপে আমরা ভীত নই’––সু চির এই বক্তব্যের পরে এ বিষয়ে সম্ভবত আর কোনো সংশয় থাকা উচিত নয় যে, রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। তারা দশকের পর দশক যেভাবে দেশহীন পরিচয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, খুন হচ্ছে, ধর্ষিত হচ্ছে, জাতিগত নির্মূলের শিকার হচ্ছে, তার আশু কোনো সমাধান নেই। বরং আমাদের এখন প্রশ্ন তোলা উচিত, সু চি ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর যে অংশটি রাখাইনে গণহত্যা চালাচ্ছে, যে সেনাবাহিনীর প্রধানকে এই সহিংসতার জন্য দায়ী করা হচ্ছে, তার বিচার হবে কি না? এখনো কি আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার সময় হয়নি? এখনো কি মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপের সময় হয়নি?
যদিও মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে একটি আন্তর্জাতিক গণ-আদালতে শেষ পর্বের শুনানি চলছে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী, পুলিশ ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী এবং সু চিকে যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে এরইমধ্যে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা এজাহারের ভিত্তিতে অভিযোগপত্র গত মার্চে লন্ডনের কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত রোমভিত্তিক পারমানেন্ট পিপলস ট্রাইব্যুনালের (পিপিটি) সূচনা অধিবেশনে গৃহীত হয়। ব্যতিক্রমধর্মী এই গণ-আদালতের ইতিহাসে এই প্রথম জেনারেলদের পাশাপাশি শান্তিতে নোবেল বিজয়ী কেউ নৈতিকভাবে দণ্ডিত ও দোষী সাব্যস্ত হতে চলেছেন। যদিও এই প্রতীকী শাস্তিকে মিয়ানমার সরকার বা সু চি কতটা আমলে নেবেন, তা এখনই চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায়। শুক্রবার এই মামলার রায় দেওয়ার কথা রয়েছে।
কোনো একজন ব্যক্তির অপরাধের শাস্তি দেওয়া সহজ। কিন্তু যখন কোথাও খোদ রাষ্ট্রই সন্ত্রাস চালায় এবং গণহত্যায় মদদ দেয়, তার বিচার করা কঠিন। যদিও গণহত্যার বিচারের জন্য আইসিসি নামে একটি আন্তর্জাতিক আদালত রয়েছে। বাংলাদেশ চাইলে এই আদালতের শরণাপন্ন হতে পারে। যদিও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মিয়ানমারকে শাস্তির আওতায় আনতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে দাবি উঠছে বিশ্বের নানা প্রান্তেই। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ মিয়ানমারের ওপর সুনির্দিষ্ট অবরোধ আরোপ করুক—এমন দাবি জনিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে সামরিক হস্তক্ষেপের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো আগ্রহ নেই। অথচ এই যুক্তরাষ্ট্রই ১৯৯৫ সালে বসনিয়ায় এবং ২০১৪ সালে ইরাকের কুর্দিস্তানে গণহত্যা বন্ধে সামরিক পদক্ষেপ নিয়েছিল। সামরিক পদক্ষেপের বাইরেও মিয়ানমারের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ কিংবা দেশটির শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং তাদের সম্পত্তি জব্দ করা যেতে পারে বলেও মনে করে এইচআরডব্লিউ। সব ধরনের সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি, সহায়তাসহ মিয়ানমারের ওপর বিদ্যমান অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা সম্প্রসারিত করারও দাবি উঠেছে।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংসতার কারণ হিসেবে ব্যাংককভিত্তিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক অ্যান্থনি ডেভিস ডেভিস বলেন, টাটমাডো নামে পরিচিত মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কয়েক দশক ধরে ছোটখাটো বিদ্রোহ দমনে অভিযান চালিয়েছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে। ওই সময়গুলোতে তাদের নৃশংসতার কোনো বিচার না হওয়ার ফলে সেনারা আরো বেশি আগ্রাসী ও নৃশংস হয়ে উঠেছে।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার তথা দেশটির স্টেট কাউন্সিলর সু চির বিরুদ্ধে সারাবিশ্বেই জনমত প্রবল হচ্ছে। এরই মধ্যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে একটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচি স্থগিত করেছে ব্রিটিশ সরকার। সু চিকে দেওয়া সম্মাননা স্থগিত করেছে যুক্তরাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম ট্রেড ইউনিয়ন ইউনিসন। মিয়ানমারে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের প্রচারাভিযানের সময় অং সান সু চি কারাবন্দি থাকাকালে ২০১০ সালে তাঁকে এ সম্মাননা দিয়েছিল ইউনিসন। দেশটির ব্রিস্টল ইউনিভার্সিটিও সু চিকে দেওয়া সম্মাননা স্থগিত করার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করছে। তাঁকে সম্মানসূচক ডিগ্রি দিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়টি। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের স্টুডেন্টস ইউনিয়নও জানিয়েছে যে তারা সু চির সম্মানিত প্রেসিডেন্ট পদ প্রত্যাহার করে নেবে। তবে এসব উদ্যোগ সু চিকে কতটা লজ্জায় ফেলল বা তিনি কতটা লজ্জাবোধ করলেন, তা বলা মুশকিল। কেননা একসময় গণতন্ত্রের দেবী হিসেবে সারাবিশ্বে স্বীকৃতি পেলেও এখন তিনি একজন সেনাবাহিনীর দাসী বৈ কিছু নন।
লেখক : সাংবাদিক ও লেখক