উইকিপিডিয়ায় বাংলা চর্চা
খবরে প্রকাশ, ২০১৫ সালে ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের জন্য একুশে পদক পেয়েছেন প্রয়াত পিয়ারু সর্দার (মরণোত্তর)। কে এই পিয়ারু সর্দার? তাঁকে নিয়ে তো পত্র-পত্রিকায় খবর চোখে পড়ে না, টেলিভিশনে কোনো ডকুমেন্টারিতেও তো তাঁর ছবি কখনই দেখি নাই। এমন মানুষ একুশে পদক পেলেন অথচ তাঁর সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। গুগলে ‘পিয়ারু সর্দার’ সার্চ দিতেই সার্চ ৩০০টা সার্চ রেজাল্ট দেখালেও ক্লিকের পর ক্লিক করে গেলেও তিনি কে তা আর জানা গেল না। সব কিছুর তথ্য ভাণ্ডার উইকিপিডিয়াতেও নেই তাঁর নাম তথ্য! কে এই পিয়ারু সর্দার? বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীর মাধ্যমে বুঝলাম তাঁরাও জানে না কে এই পিয়ারু সর্দার। বাংলা ভাষা আন্দোলনে তাঁর ভূমিকাই বা কি তা সরকারি কোনো ওয়েবসাইটেও বিস্তারিত নেই। দিন কয়েক পরে উইকিপিডিয়াতে দেখা মিলল ‘পিয়ারু সর্দার’ নামের একটি নিবন্ধ।
পরিপূর্ণ না হলেও পিয়ারু সর্দার কে ছিলেন, তাঁর ভূমিকা কী ছিল ভাষা আন্দোলনে তা-ই জানা গেল নিবন্ধটি পড়ে। নাম না জানা কোনো এক উইকিপিডিয়ান রাত জেগে, পত্রিকার তথ্যসূত্র ঘেটে তৈরি করেছে নিবন্ধটি। বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য নিয়ে নানা বিষয়ে এমনই কয়েক হাজার নিবন্ধ তৈরি করে তথ্য প্রকাশ করে যাচ্ছে বাংলা উইকিপিডিয়া। আগামীতে কেউ পিয়ারু সর্দারকে কেন পুরস্কার দেওয়া হয়েছে তা গুগলিং করেই জানতে পারবে। উইকিপিডিয়ার কল্যাণেই এমন হাজারো তথ্য প্রতিদিন যুক্ত হচ্ছে ইন্টারনেটে আমাদের মাতৃভাষা বাংলাতে ৷
গেল সহস্রাব্দের পুরোটাই ছিল সীমাবদ্ধ জ্ঞানের চর্চা। অতীতের শিলালিপির জ্ঞান, মধ্যযুগের হাতে লেখা বই পুথি বিবর্তনের হাত ধরে ছাপাখানা থেকে তাবৎ দুনিয়ায় জ্ঞানের বিকাশ হতো। জ্ঞান-বিজ্ঞান, তথ্য সবার জন্য সে সময় উন্মুক্ত ছিল না। রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের তথ্য জানার জন্য বইপত্র, সংবাদপত্র ছাড়া কোনোই মাধ্যম ছিল না। বিশ শতকের শেষে ইন্টারনেটের জাল সীমাবদ্ধ জ্ঞান চর্চাকে উন্মুক্ত করার পথ বাতলে দেয়। সংবাদ যেখানে মানুষকে দেড় দিনের পুরনো সংবাদ দিয়েই সন্তুষ্ট করে, সেখানে ইন্টারনেট নিমেষেই খবর, মুহূর্তেই তথ্য প্রদানের নানা অনুষঙ্গ আর ওয়েব জাল তৈরি করে। গত সহস্রাব্দের সবচেয়ে বড় তথ্য ভাণ্ডার ছিল এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা। ইন্টারনেটের এ যুগে ব্রিটানিকা ব্যবহারের চল নেই বললেই চলে। যেকোনো তথ্যের জন্য মানুষ এখন গুগল থেকে চলে যায় উইকিপিডিয়াতে। বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বড় উন্মুক্ত বিশ্বকোষের নাম উইকিপিডিয়া। মুক্ত তথ্যই নয়, উন্মুক্তভাবে তথ্য সংগ্রহ আর প্রকাশের ভিন্নধারার বিজ্ঞাপনবিহীন এক অন্তর্জাল। উইকিমিডিয়া ফাউন্ডেশন পরিচালনায় সারা বিশ্বের ২৮৭টি ভাষায় রয়েছে উইকিপিডিয়া। ২০০১ সালে যাত্রা শুরু করে ইংরেজি উইকিপিডিয়া। ২০০৪ সালে চালু হয় বাংলা সংস্করণ। এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে উইকিমিডিয়া বাংলাদেশ চ্যাপ্টার। দুই বাংলার সাধারণ ব্যবহারকারীরা সামনে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বাংলা উইকিপিডিয়াকে।
পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষাপ্রেমী স্বেচ্ছাসেবকদের আগ্রহ আর পরিশ্রমেই কোনো ধরনের লাভজনক কার্যক্রম ছাড়াই পরিচালিত হচ্ছে উইকিপিডিয়ার কার্যক্রম। বাংলা উইকিপিডিয়ার (bn.wikipedia.org) বর্তমানে নিবন্ধের সংখ্যা ৩৪ হাজারের বেশি। এক জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলা উইকিপিডিয়ার ব্যবহার বেড়েছে ৪৬ শতাংশ। (প্রথম আলো, ০৮ মার্চ, ২০১৪)
কোনো বিষয় বা তথ্য ইন্টারনেটে খুঁজলে সার্চ পাতায় সবার প্রথমে উইকিপিডিয়ার লিংক দেখা যায়। সারা বিশ্বের কোটি কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর কাছে তথ্য খোঁজার প্রথম মাধ্যমই এখন উইকিপিডিয়া। ইন্টারনেটে বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষা বিষয়ক নানা ধরনের তথ্যের সবচেয়ে আধুনিক, আপডেট ও সমৃদ্ধ ভাণ্ডার এখন বাংলা উইকিপিডিয়া।
উইকিপিডিয়া হলো একটি উন্মুক্ত বিশ্বকোষ। এখানে হাজার-হাজার সাধারণ মানুষ তাদের প্রয়োজনীয় তথ্য, ছবি আর পরিসংখ্যান একত্রীকরণের মাধ্যমে সবচেয়ে বড় উন্মুক্ত বিশ্বকোষ তৈরি করেছে। বিভিন্ন ভাষার উইকিপিডিয়াতে পৃথিবীর প্রায় সব জ্ঞানের সম্মিলিত সংকলন গড়ে তোলা হয়েছে। এই জ্ঞান আর তথ্যকে কপিরাইট বা স্বত্বের বেড়াজালে বন্দি না করে সম্পূর্ণভাবে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। যেকোনো বিশ্বকোষ, অভিধান বা এনসাইক্লোপিডিয়ার কিন্তু স্বত্ব রয়েছে। লেখক প্রকাশকের অনুমতি ছাড়া তথ্য ব্যবহার করা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু উইকিপিডিয়া পুরোপুরি মুক্ত বিশ্বকোষ। এখানে যখন ইচ্ছা যে কেউ নির্ভর যোগ্য তথ্যসূত্র ব্যবহারের মাধ্যমে যেকোনো জ্ঞান ও তথ্য প্রকাশ করতে পারে।
প্রযুক্তি নির্ভর এ সময় জ্ঞানকে বইয়ের পাতায় বা আইনের মারপ্যাচে আটকে রাখা অসম্ভব। তথ্য বা জ্ঞানের তো কোনো ব্যক্তি মালিকানা বলে কিছু নেই। জ্ঞান সবার জন্য, সবার অধিকার আছে তথ্য জানার আর প্রকাশের। উইকিপিডিয়াতে প্রকাশিত সব তথ্য ছবি সবার জন্য উন্মুক্ত। ছাপা সংস্করণের বিশ্বকোষগুলোর চেয়ে উইকিপিডিয়াকে প্রতিমুহূর্তেই আপডেট করে চলেছেন এর স্বেচ্ছাসেবকরা। বাংলা উইকিপিডিয়া গড়ে তুলতে তরুণ প্রজন্মের চেষ্টা লক্ষণীয় হলেও, এর তথ্যের নির্ভুলতা নিয়ে খানিকটা প্রশ্ন থাকলেও বাংলা উইকিপিডিয়ানরা তথ্য নির্ভুল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। উইকিপিডিয়াতে আস্তে আস্তে এই অবদানকারীর সংখ্যা বাড়ছে, অবদান বাড়ছে ৷ সঙ্গে নিবন্ধের সংখ্যা এবং মানও বাড়ছে৷
গেল এক দশকের বেশি সময় ধরে বাংলা ভাষাভাষীদের তথ্যের অনন্য এক সূত্র বাংলা উইকিপিডিয়া। বাংলাদেশের বাংলা ভাষাভাষীসহ ভারতের কলকাতা, আসামসহ বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের মানুষের অংশগ্রহণ আছে এই উন্মুক্ত কোষে। উন্মুক্ত তথ্যপ্রবাহের এ সময়ে ইন্টারনেটে বাংলা কনটেন্টের মান বেশ হতাশাজনক। ইংরেজি বা ইউরোপীয় ভাষাগুলোর বাইরে কম জনসংখ্যার জাপানি ভাষার কনটেন্ট ইন্টারনেটে বেশ শক্তিশালী। বাংলাদেশে পাঁচ কোটি মানুষ ইন্টারনেটের সুযোগের আওতায় থাকলেও ইন্টারনেটে বাংলা কনটেন্ট মানে বাড়ছে না। বাংলা উইকিপিডিয়ার স্বেচ্ছাসেবকরা সেই কনটেন্টের গুণগত মান বাড়ানোর জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে।
অনেকটা কৌতুক করে বলা হয়, 'উইকিপিডিয়াতে যে তথ্য নেই সে তথ্য বলে পৃথিবীতে আসলে কিছু নেই।' গ্রহণযোগ্য তথ্যের আধার হিসেবে উইকিপিডিয়া প্রতি মুহূর্তেই বিকশিত হচ্ছে। বিভিন্ন ভাষার সাধারণ অবদানকারী উইকিপিডিয়ানরা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন মুক্ত তথ্য চর্চার এই ওয়েবজালকে। বাংলা উইকিপিডিয়াতে ৭৭ হাজারের বেশি নিবন্ধিত ব্যবহারকারী বা অবদানকারী আছে। যদিও সক্রিয় মাত্র ৫০০ জনের বেশি নয়। মাতৃভাষা বাংলাকে উন্মুক্ত বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়াতে ধীরে ধীরে একটি শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে অবদানকারীরা। বর্তমানে বাংলাদেশে বিনামূল্যে মুঠোফোনের মাধ্যমে উইকিপিডিয়া ব্যবহার করা যায়। উইকিপিডিয়া জিরো নামের বিশেষ সেবার মাধ্যমে যে কেউ মুঠোফোন থেকে উইকিপিডিয়ার তথ্য পেতে পারে। ব্যবহারকারীরা বিনামূল্যে উইকিপিডিয়া ব্যবহার করতে পারেন।
এশিয়ার বিভিন্ন ভাষাগুলোর মধ্যে বাংলার অবস্থান অনেক আগে থেকেই সামনের দিকে। ১৯১৩ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি বাংলা ভাষার অবস্থানকে অনেক দূরে নিয়ে যায়। বাংলা উইকিপিডিয়া সংশ্লিষ্ট স্বেচ্ছাসেবকরা অনলাইনে ১গ বছর ধরে উইকি বই, উইকি অভিধানসহ বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলা ভাষায় তথ্য চর্চা ও প্রকাশের চেষ্টা করে যাচ্ছে। দেশের বিশ্ববিদ্যায়গুলোতে ইংরেজি চর্চার গুরুত্ব, করপোরেট দুনিয়াতে ইংরেজিভাষী বাংলাদেশিদের দৌরাত্ম্যে বাংলা এখন সমাজের উচ্চশ্রেণির কাছে বিলাস দ্রব্য। এক সময় বাংলায় বিজ্ঞান চর্চা করতেন জগদীশ চন্দ্র, সত্যেন বোস সেই বাংলা এখন দেশে এলিট শ্রেণির কাছে প্রায় অচর্চার এক বিষয়। বাংলা উইকিপিডিয়ার স্বেচ্ছাসেবকরা বাংলায় তথ্য চর্চা ও সাধারণ সবার কাছে সেই তথ্য প্রকাশের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে যে মাতৃভাষা চর্চার বীজ বোনা হয়েছিল, তা অনলাইনে ধরে রাখতে বাংলা উইকিপিডিয়ানরা চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
জাহিদ হোসাইন খান, উইকিপিডিয়ার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস অ্যাম্বাসেডর।
উইকিপিডিয়ার আইডি: Aashaa
[email protected]