এশিয়ায় নতুন ‘নৌকা মানুষ’, অত্যাচারিত, সাগরে পরিত্যক্ত
আমরা যখন খাচ্ছি-ঘুমাচ্ছি, পরিবারের সাথে আনন্দে সময় কাটাচ্ছি, ঠিক সেই সময়েই মাছ ধরার ট্রলারে গাদাগাদি করে হাজারো লোক ভাসছে দক্ষিণ এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সাগরে। দিনে মাথার ঠিক ওপরে গনগনে রোদ, রাতে হিম কুয়াশা। খাবার বা পানীয় কোনোকিছুই নেই সাথে। তীব্র ক্ষুধায় এরই মধ্যে মারা গেছেন নারী, শিশুসহ কয়েকজন। সাগরের নোনা পানিতে নাতিশীতোষ্ণ দেশের ওই মানুষগুলোর শরীরে দেখা দিয়েছে ক্ষত।
কয়েকদিন আগে থাইল্যান্ড থেকে মাছ ধরার নৌকায় করে সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের। এর পর থেকে অবিরাম ভেসে চলা। মাঝে মাঝে সবুজ তীর যে চোখে পড়ছে না, তা নয়। কিন্তু সেই তীরে নামার কোনো উপায় নেই।অসহায় মানুষগুলোর হাজারো অনুরোধ, কান্না উপেক্ষা করে সংশ্লিষ্ট দেশের নৌবাহিনী অসহায় তাদের আবার ঠেলে দিচ্ছে সাগরের স্রোতে।
গত কয়েকদিনে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হওয়ার পর মাঝে মাঝে অসহায় ওই লোকগুলোকে খাবার ও পানীয় দিচ্ছে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলো। নৌকা থেকে সাগরে নেমে ঢেউ ঠেলে সাঁতরে সংগ্রহ করতে হচ্ছে ওই ত্রাণ। যদিও তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল।
তবু বেঁচে আছে ওরা, স্বপ্ন দেখছে ‘স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়া’ যাওয়ার। যেখানে একবার পৌঁছাতে পারলে হয়তো বেঁচে থাকার সমস্যাগুলো মিটবে তাঁদের।
গতকাল শুক্রবার রয়টার্সে ‘এশিয়ার নতুন নৌকাবাসীদের সাথে পরিচিত হোন : সাগরে না খেয়ে মরার জন্য যাদের ফেলে রাখা হয়েছে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। যাতে কেস স্টাডি হিসেবে উল্লেখ করা আছে, থাইল্যান্ডের উপকূল থেকে একটি মাছ ধরার নৌকায় করে সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া প্রায় ১০০ লোকের কথা; যারা সবাই বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার থেকে আসা অভিবাসী।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, একশর বেশি অভিবাসীকে একটি সরু পুরোনো মাছ ধরার নৌকায় করে সমুদ্রে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। এরপর রাতের অন্ধকারে সেই নৌকার চালক ও তার সহযোগীরা নেমে স্পিডবোটে করে পালিয়ে যায়। আর অসহায় শতাধিক অভিবাসীকে নিয়ে কাঠের নৌকাটি ভাসতে থাকে দক্ষিণ এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সাগরে।
এর আগে তিন সপ্তাহ ধরে থাই চোরাচালানকারী এবং পুলিশের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছিলেন তারা। বন্দুকের বাঁট দিয়ে মেরে কয়েকজনকে আহত করা হয়েছিল এবং অনেকের গায়ে গরম পানি ঢেলে নির্যাতন চালানো হয়েছিল।
প্রতিবেদনে মোহাম্মদ হোসেন নামে এক রোহিঙ্গা মুসলিম যুবকের কথা উল্লেখ করা হয়, যে মালয়েশিয়া গিয়ে সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্নে বিভোর হয়ে মধ্য এপ্রিলে ঘর ছেড়েছিল। এক মাস পরে এসে এখন সে একটি মাছ ধরার নৌকার এককোণে শুয়ে আছে। তাঁর মাথায় একটি কুৎসিত গভীর ক্ষত। গোড়ালির ওপরের অংশে একটা পিংপং বলের সমান মাংস ফোলা। ব্যথায় পা নাড়াতে কষ্ট হচ্ছে তাঁর। কয়েকদিন আগে পাচারকারীদের একজনকে ‘কবে ছাড়া পাবে’ শুধু এই প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করার অপরাধে একটি লোহার বল দিয়ে তাকে মারা হয়েছিল।
রয়টার্সের প্রতিবেদক জানান, দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব সাগরে ভাসমান অবস্থায় তিনটি নৌকা দেখতে পান তিনি; যেটিতে নারী, শিশুসহ মিয়ানমার ও বাংলাদেশের প্রায় ৬০০ জন মানুষ কয়েকদিন ধরে ক্রমাগত ভেসে চলছে। প্রতিবেদনে এই অসহায় মানুষগুলোকে ‘এশিয়ার নতুন নৌকামানব’ নামেও অভিহিত করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, যে নৌকায় করে মানুষগুলো ভাসছে তার ধারণক্ষমতা বড়জোর ২০০ জনের। এই সংকীর্ণ জায়গায় গাদাগাদি করে ভাসতে ভাসতে এতগুলো মানুষ কেবল অপেক্ষায় আছে কবে নৌকাটি মালয়েশিয়ার উপকূলে পৌঁছায়। নৌকায় ভেসে চলা মোহাম্মদ হোসেন রয়টার্সের প্রতিবেদককে জানান, ‘আমাদের সাথে থাকা নৌকার চালক ও দালালরা মাঝরাত্রিতে আমাদের সাগরে ফেলে চলে গেছে। আমরা জানি না আমরা কোথায় যাচ্ছি অথবা কীভাবে মালয়েশিয়া যেতে পারব। আমরা শুধু ভেসে চলছি।’
মোহাম্মদ হোসেন আরো বলেন, গত রোববার নৌকার তেল শেষ হয়ে গিয়েছিল। এর পর থেকে স্রোতের তোড়ে ভাসছে নৌকা। স্রোত কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, তা জানা নেই কারো। সর্বশেষ দুদিন আগে (বুধবার) তাঁরা নৌকার পাশ দিয়ে যাওয়া মাছ ধরার নৌকার মাঝির কাছে জিজ্ঞেস করে জেনেছেন, ইন্দোনেশিয়ার মালাক্কা এলাকার পাশ দিয়ে ভেসে যাচ্ছেন তাঁরা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এটা শুধু নির্দিষ্ট একটা নৌকার চিত্র। অসমর্থিত সূত্রের হিসাব অনুযায়ী ভাসমান এই জেলখানায় আছে আট হাজারেরও বেশি মানুষ। গত সপ্তাহেই আড়াই হাজারেরও বেশি মানুষকে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার উপকূল থেকে নৌকায় করে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। এর আগে সপ্তাহজুড়ে থাইল্যান্ডের উপকূল থেকে প্রায় সাত হাজার মানুষকে নৌকায় করে সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। দুই সপ্তাহজুড়ে দেশটিতে মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশ কড়া পদক্ষেপ নেওয়ায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে যাওয়া এই দরিদ্র মানুষগুলো পড়ে গেছে মৃত্যুর শংকায়। দারিদ্র্যের কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার শটকাট রাস্তা বন্ধের এই কাজটি সহজে সমাধানযোগ্য নয়।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ৭০-এর দশকে ভিয়েতনামের শরণার্থীরা নৌকায় এসে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার ওই দেশগুলোতে যে সংকট সৃষ্টি করেছিল, এভাবে চলতে থাকলে তেমন পরিস্থিতিরই আশঙ্কা করছে কর্তৃপক্ষ। আর এর ফলেই নৌকায় কোনোমতে বেঁচে থাকা ওই মানুষগুলোর প্রতি ন্যূনতম মানবিকতা দেখাতে রাজি নয় থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়াসহ দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলো। আর এতেই সবচেয়ে বড় আশঙ্কাটি সৃষ্টি হচ্ছে, কী আছে অসহায় ওই লোকগুলোর ভাগ্যে। ভাসমান এই মানুষগুলো সাগরেই কি না খেয়ে মরবে?
এরই মধ্যে আন্দামান সাগর ও মালাক্কা প্রণালিতে পাচারকারীদের নৌকায় ভাসমান হাজার হাজার মানুষের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি-মুন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশ এসব নৌকাকে তীরে ভিড়তে না দিয়ে সাগর থেকেই ফিরিয়ে দিচ্ছে — এমন খবরেও তিনি উদ্বেগ জানিয়েছেন।
বিপদে পড়া এসব মানুষকে সহযোগিতার জন্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন বান কি-মুন। এ ব্যাপারে ভাসমান মানুষদের বাঁচাতে নিজেদের সীমান্ত ও বন্দর খোলা রাখার জন্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান মহাসচিব।
কিন্তু বান কি-মুনের এই আহ্বানে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো কতটুকু সাড়া দিচ্ছে এ ব্যাপারে প্রশ্ন উঠেছে এরই মধ্যে। বঙ্গোপসাগর দিয়ে অভিবাসী অনুপ্রবেশ সংকটের সমাধান অনুসন্ধানে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে চলতি মাসের শেষের দিকে থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিতব্য এক আঞ্চলিক বৈঠকে যোগ দিতে অপারগতার কথা জানিয়েছে মিয়ানমার ও ইন্দোনেশিয়া।
এ ছাড়া সাম্প্রতিক উদ্ভূত মানবিক সমস্যার কথা উল্লেখ করে ভারত মহাসাগরে নৌকা দিয়ে বিভিন্ন দেশের উদ্দেশে পাড়ি জমানো রোহিঙ্গা মুসলমানদের আশ্রয় দিতে থাইল্যান্ডকে তাগিদ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি একই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সমুদ্রে ঠেলে না দিতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু আজ শনিবার পর্যন্ত অভিবাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালু রেখেছে থাইল্যান্ড।
থাইল্যান্ডের প্রশাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে, তারা সংকট দেখেও না দেখার ভান করছে। এসব অভিযোগের ইতি টানতে থাইল্যান্ড সরকার আগামী ২৯ মে রাজধানী ব্যাংককে এক বৈঠকের আয়োজন করেছে। থাইল্যান্ড কর্তৃপক্ষ বলছে, অভিবাসীদের এ উপচে পড়া ভিড়ের ‘মূল কারণ’ খুঁজে বের করাই হবে বৈঠকের মূল লক্ষ্য।