রফিক ভাই থাকবেন, তিনি আমাদের মধ্যেই থাকবেন : আসাদুজ্জামান নূর
‘বাংলা সাহিত্যে নক্ষত্রদের মধ্যে কবি রফিক আজাদ অন্যতম। দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল অকৃত্রিম। তাঁর অধিকাংশ সৃষ্টিকর্মের মধ্যে স্থান পেয়েছে দেশের মানুষের সংগ্রামের বিষয়সমূহ,’ কবির শেষ যাত্রায় এসে কথাগুলো বলছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। আজ সোমবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে কবি রফিক আজাদের মরদেহে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণের সময় তিনি এসব কথা বলেন।
মন্ত্রী আরো বলেন, ‘দেশপ্রেমিক এ মুক্তিযোদ্ধা বঞ্চিত মানুষের প্রভাবশালী কণ্ঠস্বর ছিলেন। তাঁর চলে যাওয়াটা বাহ্যিক। তিনি থাকবেন, তিনি আমাদের মধ্যেই থাকবেন।’
আজ সকাল ১০টা থেকে কবির জন্য কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলির আয়োজন করে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। আয়োজনের শিরোনাম ছিল ‘জীবন এই নাম মরণরেই চিরসখা!’ দেশবরেণ্য কবি, বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিক আজাদের প্রতি জাতির শ্রদ্ধাঞ্জলি।’ শনিবার দুপুরে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) কবি রফিক আজাদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
এ সময় সর্বপ্রথম শ্রদ্ধা জানান কবির স্ত্রী অধ্যাপক দিলারা হাফিজ ও পরিবার বর্গ। এরপর ক্রমান্বয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হারুনুর রশিদ, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, সরকারি তিতুমীর কলেজ ছাত্রলীগ, জাতীয় কবিতা পরিষদসহ নানা সংগঠন দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত কবির কফিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করে। এরই মাঝে সাড়ে ১০টার সময় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে প্রয়াত এ কবিকে রাষ্ট্রীয় সম্মান গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়।
এ সময় সদ্য প্রয়াত রফিক আজাদকে শ্রদ্ধা জানাতে আসা কবি আবু হাসান শাহরিয়ারকে মনক্ষুণ্ণ মনে হলো। একটু কথা বলতেই বের হয়ে এলো তাঁর পেছনের খবর। তিনি বললেন, ‘কবি রফিক আজাদকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বিদায় জানাতে পেরেছি তা আনন্দের। তবে এখন যেমন সবাই শ্রদ্ধা জানাতে আসছেন ঠিক তেমনি যদি হাসপাতালে থাকা অবস্থায় পাশে পাওয়া যেত সবাইকে তবে তিনি এখনো আমাদের মধ্যে থাকতেন হয়তো! এ ধরনের মানুষদের জীবদ্দশায় সম্মান জানানো উচিত। তবে তা খুব কম কবি-সাহিত্যিকই পেয়ে থাকেন।’
জাতীয় কবিতা পরিষদ শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রদান শেষে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক রফিক আজাদ সম্পর্কে বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি কবি পরিবারের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশের পাশাপাশি সব কবি-সাহিত্যিকের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানান।
সৈয়দ হক এ সময় বলেন, ‘যে হাত মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে পাকিস্তানি বাহিনীকে হটানোর জন্য, সে হাতেই তিনি কবিতা লিখেছেন। অমর পঙ্ক্তিমালার জন্ম দিয়েছে সে হাত। আমি তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় জানাচ্ছি। স্বাগতম জানাচ্ছি অমর কবিদের দলে।’
এই সময় দৃপ্ত কণ্ঠে সৈয়দ হক বলেন, ‘কবিদের মৃত্যু হয় না, কবিতারও মৃত্যু হয় না।’
বেলা ১২টার পরে কবির শবদেহ কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার হতে বাংলা একাডেমিতে আনা হয়। এই সময় বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে কবিকে শ্রদ্ধা জানান অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান, কবি নির্মলেন্দু গুণসহ অনেকে। কবির সবচেয়ে নিকট বন্ধু নাদিরা মজুমদারও ছিলেন শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রদানকারীদের দলে।
কবি রফিক আজাদকে বাংলা সাহিত্যে দেখা হয়েছে ভিন্ন মাত্রা যোগকারী হিসেবে। তাঁর কবিতায় বাঁক বদল ঘটেছে নানা সময়। তবে অধিকাংশ সময়ই তিনি অন্তরালে সরিয়ে রেখেছিলেন নিজেকে। তাঁর কবিতায় যেমন প্রেম, প্রকৃতি, পরিবেশ উঠে এসেছে তেমনি পরিষ্কারভাবে রেখা এঁকেছেন ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও বঞ্চিত মানুষের ছবি। যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ‘ভাত দে হারামজাদা, তা না হলে মানচিত্র খাব।’
বেলা পৌনে ২টার দিকে কবির শবদেহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে নেওয়া হয়। জোহরের নামাজের পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের খতিব ড. সৈয়দ মোহাম্মদ ইমদাদ উদ্দিন জোহরের নামাজের পর কবির প্রথম জানাজা পড়ান। এ সময় পরিবারের পক্ষ হয়ে কবিপুত্র অভিন্ন আজাদ বাবার আত্মার মাগফিরাত কামনাসহ সবার কাছে সদ্য প্রয়াত বাবার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করেন। পরে ধানমণ্ডিতে নিজ বাসভবনে জানাজা শেষে বিকেলে রাজধানীর মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে কবিকে চিরশায়িত করা হয়।