নরসিংদীতে পরকীয়ার জেরে স্ত্রীসহ দুই সন্তান হত্যা
নরসিংদীর বেলাবোতে পরকীয়ার জেরে এবং প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে হত্যা করেছেন এক ব্যক্তি। হত্যার পর ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে সাজান নাটক। পরে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে আসল ঘটনা।
এ ঘটনায় এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তিন খুনের ঘটনায় শত শত উৎসুক জনতা সেখানে ভিড় জমায়।
হত্যাকাণ্ডের শিকার তিন জন হলেন—গিয়াস শেখের স্ত্রী রহিমা বেগম (৩৫), তাঁর ছেলে রাব্বি (১৩) ও মেয়ে রাকিবা আক্তার (৬)।
আজ রোববার দুপুরে উপজেলার পাটুলি ইউনিয়নের বাবলা গ্রামের শেখবাড়ি থেকে মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। দিনভর নানা জল্পনা-কল্পনার পর বেলা গড়াতেই খুলতে শুরু করে রহস্যের জট। সর্বশেষ হত্যার শিকার গৃহবধূর স্বামীকে গ্রেপ্তারের পর স্ত্রী-সন্তানসহ একে একে তিন জনকে হত্যার দায় স্বীকার করেন তিনি। পরে তাঁর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ছুরি ও ক্রিকেট ব্যাট জব্ধ করা হয়।
এ ঘটনায় নিহতের স্বামী গিয়াস শেখ, প্রতিবেশী রেনু মিয়া, রিমন শেখ, রাজিবসহ কমপক্ষে পাঁচ জনকে আটক করেছে বেলাবো থানা পুলিশ, ডিবি ও পিবিআই।
পিবিআই সূত্র জানিয়েছে, নিহত রহিমা বেগমের স্বামী গিয়াস শেখ পেশায় রং মিস্ত্রি। তিনি মাদকাসক্ত ও জুয়াড়ি।
আজ সকালে একই পরিবারের তিন জন নিহতের ঘটনায় নরসিংদী জেলা পুলিশ, ডিবি পুলিশ, বেলাবো থানা পুলিশ ও পিবিআইয়ের সদস্যরা ঘটনাস্থলে যান। সেখানে গিয়ে দেখেন, একটি ঘরের মেঝেতে স্ত্রী রহিমার রক্তাক্ত মরদেহ পড়ে আছে। অন্য একটি ঘরে বিছানার ওপর দুই সন্তানের মরদেহ। শুরু হয় তদন্ত।
একপর্যায়ে নিহত রহিমার স্বামী পুলিশকে জানান, কাজের জন্য তিনি স্ত্রী ও দুই সন্তানকে বাড়িতে রেখে গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় গাজীপুরে যান। এরই মধ্যে সকালে মোবাইল ফোনে স্ত্রী ও সন্তানদের মৃত্যুর খবর পান। বাড়িতে এসে দেখেন একটি ঘরের মেঝেতে স্ত্রী রহিমার রক্তাক্ত মরদেহ পড়ে আছে। অন্য একটি ঘরে বিছানার ওপর দুই সন্তানের মরদেহ। পরে তাঁর চিৎকারে আশপাশের লোকজন এসে পুলিশকে খবর দেয়।
পরে পুলিশ এসে নিহত তিন জনের মরদেহ উদ্ধারের কাজ শুরু করে।
পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার মো. এনায়েত হোসেন মান্নান বলেন, ‘তিনটি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার পর নিহতদের স্বজনরা কান্নাকাটি শুরু করেন। কিন্তু, নিহত রহিমার স্বামী গিয়াস শেখের মধ্যে কোনো ধরনের অনুশোচনা বা প্রতিক্রিয়া ছিল না। তাই তাঁর প্রতি সন্দেহ হয়। পরে তাঁর তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে এলাকায় থাকার তথ্য পায় পিবিআই। একই সঙ্গে পরকীয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হয় পিবিআই। তখন তাঁকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
একপর্যায়ে গিয়াস হত্যার কথা স্বীকার করেন। পরে তাঁর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বাড়ির অদূরের একটি খাল থেকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ছুরি এবং একটি জঙ্গল থেকে রক্তমাখা ক্রিকেট ব্যাট জব্দ করা হয়।’
পুলিশ সুপার আরও বলেন, ‘গিয়াস শেখের জবানবন্দিতে গাজীপুর চলে যাওয়ার কথা বললেও এটা সত্য নয়। সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলেও গভীর রাতে তিনি বাড়ি ফিরে আসেন। তাঁর স্ত্রী ও সন্তানরা ঘুমিয়ে পড়লে রাত আড়াইটার দিকে গিয়াস ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে তাঁর স্ত্রীকে উপর্যুপরি পিটান। পরে তাঁকে মাটিতে ফেলে মাথায় ও বুকের মাঝখানে ছুরি দিয়ে আঘাত করেন। স্ত্রীকে হত্যার পর পাশের ঘরে ঘুমন্ত ছেলেমেয়েকে ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে গলা চেপে ধরে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন।’
পুলিশ সুপার এনায়েত আরও বলেন, ‘বাড়ির রাস্তা নিয়ে প্রতিবেশী রেনু মিয়াদের সঙ্গে গিয়াস শেখের ঝগড়া ছিল। তাই মূলত প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে এবং পরকীয়ার কারণেই ঠাণ্ডা মাথায় স্ত্রী ও সন্তানদের হত্যা করেন।’
শুধু তাই নয়, হত্যার পর আইনের চোখ ফাঁকি দিতে পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা ও পিবিআইকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে দুপুর পর্যন্ত বিভ্রান্ত করে রাখেন।
এদিকে, শরীফা আক্তার নামে এক প্রতিবেশী জানিয়েছেন, নিহত রহিমার কাছে জামা সেলাই করতে দিয়েছেন তিনি। সকাল ৭টার দিকে তিনি রহিমাদের বাড়িতে আসেন। এসে ঘরের দরজা খোলা দেখতে পান। একই সঙ্গে রহিমাকে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখেন। অনেক ডাকাডাকি করলেও তিনি কোনো সাড়া দেননি। কাছে গিয়ে রহিমার রক্তাক্ত মরদেহ পড়ে থাকতে দেখেন। এ সময় পাশের ঘরে চৌকির ওপর দুই সন্তানের মরদেহ পড়ে থাকতে দেখেন।
পিবিআইয়ের হাতে আটক হওয়ার আগে নিহত রহিমা’র স্বামী গিয়াস শেখ জানিয়েছেন, গত ১৫ দিন আগে বাড়ির পেছন থেকে একটি গাছ বিক্রি করেন তিনি। বাড়ির চার পাশজুড়ে প্রতিবেশী রেনু মিয়ার জায়গা। এই গাছটি বাড়ির ওপর দিয়ে নিতে গেলে রেনু মিয়া বাধা দেন। এ নিয়ে তাঁদের সঙ্গে প্রতিবেশী রেনু মিয়ার ঝগড়া হয়। ওই সময় রেনু মিয়া তাদের মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছেন বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
তাঁর ছোট ভাইয়ের স্ত্রী ফরিদা বেগম জানান, গিয়াসের বাড়ির চারদিকের পুরো জায়গা রেনু মিয়ার। রেনুর জায়গা দিয়েই গিয়াসদের চলাচল করতে হয়। জমিজমা নিয়ে রেনুর সঙ্গে তাঁর দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছিল। কয়েক দিন আগে গিয়াস বিক্রির জন্য তাঁর বাড়ির কিছু গাছ কাটেন। এই গাছ রেনুর জায়গা দিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে রেনু বাধা দেন। এ নিয়ে তাদের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়। স্থানীয়রাও তাদের দ্বন্দ্বের বিষয়টি জানেন।
সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাবলা গ্রামে পাশাপাশি দুটি মাটির ঘর। একটির মেঝেতে পড়ে আছে রহিমা বেগমের রক্তাক্ত মরদেহ। পাশের আরেকটি ঘরে পাশাপাশি দুটি শিশুর মরদেহ। বাড়ির আঙিনাজুড়ে শত শত উৎসুক জনতা। পরে নরসিংদী জেলা পুলিশ, বেলাবো থানা পুলিশসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার লোকজন ঘটনাস্থলে গিয়ে তদন্ত শুরু করেন। পাশেই নিহত রহিমার বড় ভাইয়ের স্ত্রী কান্নকাটি করছেন। ঘরের পেছনে একটি চেয়ারে বসে আছেন স্বামী গিয়াস শেখ। স্বজন ও এলাকাবসীর মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এলেও তার চোখে-মুখে শোকের ছাপ দেখা যায়নি।
অসঙ্গতিপূর্ণ আচরণে পিবিআই সুপারের সন্দেহ হয়। পরে তাকে আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে প্রকৃত রহস্য।