প্রতিবন্ধী ভাতা আত্মসাৎ চেয়ারম্যান, ব্যাংক কর্মকর্তার!
দিনাজপুরে ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান এবং স্থানীয় সোনালী ব্যাংক শাখার ব্যবস্থাপকের বিরুদ্ধে বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধীদের ভাতার টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠেছে।
চলতি বছর হাকিমপুর উপজেলার আলীহাট ইউনিয়নে ২৪ জন বিধবা, ৫২ প্রতিবন্ধী ও ৫২ জনকে নতুনভাবে বয়স্ক ভাতার জন্য মনোনীত করা হয়। এই ১২৮ জনের ভাতার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে হাকিমপুর উপজেলার আলীহাট চেয়ারম্যান গোলাম রসুল ও স্থানীয় সোনালী ব্যাংক শাখার ব্যবস্থাপক এস এম সাখাওয়াত হোসেনের বিরুদ্ধে।
উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয় থেকে জানা যায়, এসব ভাতাভোগীর জন্য হাকিমপুর সোনালী ব্যাংক শাখায় উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের ব্যাংক হিসাবে গত জুলাই মাসে এক বছরের জন্য ছয় লাখ ৭৬ হাজার ৬০০ টাকা বরাদ্দ আসে। টাকা আসার খবর পেয়ে চেয়ারম্যান কৌশলে এসব ভাতাভোগীর নামে সোনালী ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট করার কথা বলে উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয় থেকে কার্ডগুলো উত্তোলন করে তাঁর কাছে রেখে দেন।
উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র দাবি করে, চেয়ারম্যান এবং সোনালী ব্যাংক ব্যবস্থাপক সমাজসেবা কর্মকর্তার কাছে তথ্য গোপন করে সমাজসেবা কার্যালয়ের ব্যাংক হিসাবে আসা এসব ভাতাভোগীর বরাদ্দের টাকা অবৈধভাবে উত্তোলন করেন। পরে তাদের জালিয়াতির বিষয়টি জানতে পেরে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা ভাতাভোগীদের কার্ডগুলো চেয়ারম্যানের কাছ থেকে জব্দ করে নেন।
এদিকে, গত বৃহস্পতিবার উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, চেয়ারম্যানের কাছ থেকে জব্দ করা ভাতাভোগীদের কার্ডগুলোতে ব্যাংক কর্তৃক লাল কালি দিয়ে টাকার পরিমাণ বসানো রয়েছে। কিন্তু তাতে টাকাপ্রাপ্ত এসব বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধী ভাতাভোগীর কোনো টিপসই নেই।
হাকিমপুর সোনালী ব্যাংক শাখার কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ভাতাভোগী ১২৮ জনের টাকা ব্যাংক থেকে অবৈধভাবে উত্তোলন করে চেয়ারম্যান এবং ব্যাংক ম্যানেজার সাখাওয়াত গত ১০ সেপ্টেম্বর স্থানীয় আবাসিক হোটেল ‘ক্যাপিলায়’ বসে ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছেন।
গত শুক্রবার বেলা ১১টায় সরেজমিনে আলীহাট ইউনিয়নে গেলে নতুন ভাতাভোগীর মধ্যে আমজাদ আলী ও আব্বাস আলী বলেন, ‘ব্যাংকে বয়স্ক ভাতার টাকা আসার কথা লোকমুখে শুনে ব্যাংকে যাই। তখন ব্যাংক থেকে জানানো হয়, চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। পরে চেয়ারম্যানের কাছে গেলে বলে, টাকা আসেনি, এলে জানানো হবে। সে সময় কার্ডও পাবেন, টাকাও পাবেন বলে চেয়ারম্যান ফিরিয়ে দেন।’ এর পর তাঁরা বিভিন্নভাবে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, ভাতার টাকা চেয়ারম্যান ব্যাংক থেকে তুলে নিয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আলীহাট ইউনিয়ন পরিষদের কয়েকজন ইউপি সদস্য জানান, তাঁরা উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধী ভাতাভোগীদের জন্য আসা টাকা চেয়ারম্যান ব্যাংক থেকে তুলে নিয়েছেন। তিনি এবং ব্যাংক ব্যবস্থাপক এই টাকা আত্মসাতের মাধ্যমে ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছেন। তখন সমাজসেবা কর্মকর্তা জানান, ঘটনাটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। পরে বিষয়টি ভাতাভোগীদের জানানো হয়।
এ ছাড়া প্রতিবন্ধী শাপলা বেগম বলেন, ‘আমাদের টাকা চেয়ারম্যান গ্রাস করেছে। আমরা তাঁর বিচার চাই? কেন তিনি আমাদের টাকা মারলেন।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. মইনুল ইসলাম জানান, আলীহাট ইউনিয়নে নতুন হিসাবে ৫২ জন বয়স্ক, ২৪ বিধবা ও ৫২ প্রতিবন্ধীকে চূড়ান্তভাবে তালিকাভুক্ত করা হয়। এরপর চেয়ারম্যান কৌশলে এসব ভাতাভোগীর নামে সোনালী ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট করার কথা বলে সমাজসেবা কার্যালয় থেকে কার্ডগুলো নিয়ে যান। কিন্তু কয়েক দিন পর জানা যায়, চেয়ারম্যান মিথ্যা তথ্য দিয়ে ১২৮ জন ভাতাভোগীর ছয় লাখ ৭৬ হাজার ৬০০ টাকা অবৈধভাবে ব্যাংক থেকে উত্তোলন করেছেন। তাৎক্ষণিকভাবে চেয়ারম্যানের কাছে থাকা ভাতাভোগীদের কার্ডগুলো জব্দ করে অফিসে নিয়ে আসা হয়।
এ সমাজসেবা কর্মকর্তা আরো জানান, কার্ডে ভাতাভোগীদের কোনো টিপসই নেই। চেয়ারম্যান ও ব্যাংক ব্যবস্থাপকের জালিয়াতির বিষয়টি সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
অভিযুক্ত ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম রসুল বাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি মুঠোফোনে সাংবাদিকদের জানান, তিনি ব্যাংক থেকে টাকা তুলেছেন। টাকা আত্মসাৎ করা হয়নি। সময়মতো বিতরণ করা হবে বলে ফোনের সংযোগ কেটে দেন।
এদিকে, আরেক অভিযুক্ত হাকিমপুর সোনালী ব্যাংক শাখার ব্যবস্থাপক এস এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথমে টাকা আত্মসাতের কথা অস্বীকার করেন। পরে তাঁকে ব্যাংক স্টেটমেন্ট দেখিয়ে ব্যালান্সে টাকা কম থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলেন, ‘এগুলো হিসাবের অনেক বিষয় রয়েছে। তাই আপনারা এমন কিছু করেন না, যাতে ব্যাংকের ইমেজ নষ্ট হয়।’
এ বিষয়ে গত শুক্রবার বিকেলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শুকরিয়া পারভীন জানান, ইউপি চেয়ারম্যান ভাতাভোগীদের অ্যাকাউন্ট থেকে কীভাবে টাকা তুলল, তা আশ্চর্য হওয়ার বিষয়। তিনি তো টাকা তুলতে পারেন না। এটি আত্মসাৎ বা জালিয়াতির পর্যায়ে পড়ে। এ ঘটনায় জড়িত প্রত্যেকের বিরুদ্ধে তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান তিনি।
গত ২ সেপ্টেম্বর হাকিমপুরের একটি অনুষ্ঠানে দিনাজপুর পুলিশ সুপারের (এসপি) সামনে অঝোরে কেঁদে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে একের পর এক অন্যায় ও নির্যাতনের বর্ণনা দেন একই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুর রাজ্জাক। এ সময় তিনি জীবনের নিরাপত্তা চেয়েও থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন বলেও জানান।