সাইকেলে মাধবপুরের জঙ্গলে
তিন গোয়েন্দার কিশোর পাশা, রবিন মিলফোর্ড, মুসা আমান আর জর্জিনা পার্কারদের মতো দলবেঁধে দেশের আনাচে-কানাচে সাইকেল চালাব, এই কর্মজীবনে এসে তা কখনওই ভাবিনি। কিন্তু ২০১১ সালে ছুটির দিনে সাইকেল নিয়ে ঢাকার আশপাশে ঘোরাঘুরি করে মোজাম্মেল, রাহাত, ফুয়াদ, আরিফ নামে কয়েক জন যুবক মিলে খুলে ফেলল একটি গ্রুপ—বিডিসাইক্লিস্ট। ব্যস, বাংলাদেশে ঘটে গেল সাইকেল বিপ্লব।
সেই ২০১২ সাল থেকে বিডিসাইক্লিস্ট-এর সাথে শুক্রবার সাইকেল নিয়ে ঘুরতে যাওয়া। সাইকেলে করেও ঘুরেছি বহু জায়গাতে, এমনকি শনিবার সাইকেল নিয়ে খুব দূরে দ্রুতগতিতে চালানো রাইডেও গিয়েছি সাহস করে একবার। কিন্তু ২০১৬ সালের মার্চে ফেসবুকে একটি ইভেন্ট দেখে চোখটা আটকে গেল। শ্রীমঙ্গলের সাতছড়ি চা বাগানে সাইক্লিং ও ক্যাম্পিং। ফ্যানটাস্টিক! এই তো চাই! ইভেন্ট দিয়েছে সাইক্লিস্ট ছোটন হক। এ ছাড়া শ্রীমঙ্গলের সাইক্লিস্টরাও এতে অংশগ্রহণ করবে। সন্দেহ নেই এক জন সাইক্লিস্টের জন্য খুবই লোভনীয় একটি ইভেন্ট। তা ছাড়া শ্রীমঙ্গল আমার খুবই প্রিয় জায়গা। ২০০৯ সালে গুগল আর্থ-এ রুট দেখে ট্রেনে করে দিনে দিনে ঘুরে এসেছিলাম আমার ওয়াইফকে নিয়ে। দারুণ ভালো লেগেছিল। তার পর থেকে সুযোগ পেলেই যাই।
আর এবার তো সেই স্বপ্নের চায়ের দেশে সাইক্লিংয়ের সুযোগ, সেই সঙ্গে ক্যাম্পিং। ওয়াও। এ সুযোগ কি হাতছাড়া করা যায়? কিছুতেই না। কোনও কিছু না ভেবেই ইভেন্ট পেজে কমেন্ট লিখলাম, যেতে মন চায় ছোটন। ছোটনও সাথে সাথে রিপ্লাই দিল, চলে আসেন ভাইয়া। ছোটনকে জানালাম, আমার তো তাঁবু (টেন্ট ) নেই, থাকব কোথায়। ও বলল, সমস্যা নেই। আপনি আমার তাঁবুতে থাকতে পারবেন, আমারটা চার জন শোয়া যায় এমন তাঁবু। বাহ, তাহলে তো হয়েই গেল, আর কী চাই। কোনও কিছু না ভেবে দিলাম কনফার্ম করে। যদিও বাসায় একটু আপত্তি তুলেছিল। কারণ, ট্যুরের আগে পার্টিসিপেন্টদের কাউকেই আমি ভালো ভাবে চিনতাম না। কিন্তু ছোটনের সঙ্গে কথা বলার পর সব ভয়ভীতি নিমিষেই দূর হয়ে গেল। যা-ই হোক, ঠিক হলো আমরা ২৯ মার্চ রাতে সায়েদাবাদ থেকে বাসে করে রওনা দেব।
কিন্তু ২৮ তারিখ রাত থেকেই শুরু হলো গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। আকাশের মুখ ভার। সাভার থেকে হাসিব ভাই আর মিরপুর থেকে দুর্জয় জানাল, খুব বৃষ্টি হচ্ছে, আসব কী করে। আমি সাহস দিলাম, আরে ব্যাপার না; বৃষ্টি থেমে যাবে সন্ধ্যার মধ্যে। বাস রাত ১১টায়, তাই চিন্তুার কিছু নেই বলে তাদের অভয় দিলাম। যাক, মনকে শক্ত করে সব গুছিয়ে রাত ৮টার দিকে দুর্জয়কে নিয়ে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে সায়েদাবাদ পৌঁছালাম; মানে ধীরে ধীরে সাইকেল চালালাম আর কি। হাসিব ভাইও চলে আসল আধাঘণ্টা পর। ছোটন আমাদের মধ্যে বেশি অভিজ্ঞ। সে আসল তাঁবুটাবু নিয়ে রাত ১০টায়। এই সুইস টেন্টগুলোতে আগে কখনও থাকিনি, এগুলো বেশ মজবুত আর হালকা। যা-ই হোক, ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেছে। এক ঘণ্টা সময় বাকি বাস ছাড়ার, তাই আমরা ছোটনের পরিচিত কাউন্টারে মালপত্র রেখে ডিম পরোটা, কেক ও চা দিয়ে রাতের খাবার শেষ করলাম। এর মধ্যে বাসের ছাদে আমাদের চার জনের চারটা সাইকেল বাঁধা কমপ্লিট। বাইক প্যাকিংয়ের সময় আমার ওয়াটার বটল আর ছোটনের সানগ্লাস কোথায় হারাল কে জানে। ছোটন আবার প্রতি ট্যুরেই কিছু না কিছু হারায়, এটা ওর একটা ঐতিহ্য আর কি। বাস ছাড়ল নির্ধারিত সময়ের ২০ মিনিট পর। বাস ছাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলাম। ঘুম ভাঙলে দেখি প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে। ঝোড়ো বাতাস পারলে বাসটাকে উড়িয়ে মাঠের মধ্যে নিয়ে ফেলে। আর বাসের ছাদের ফুটো দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে। আমার গায়ে শুধু পানি।
ভোর ৪টার মধ্যেই আমরা শ্রীমঙ্গল পৌঁছে গেলাম। তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে সাইকেলগুলো নামালাম বাস থেকে। তার পর একটি মার্কেটের নিচে আশ্রয় নিলাম। রাতে ভালো করে না খাওয়ায় খিদে জানান দিচ্ছিল ভালোই। কিন্তু এবার আমাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন।
চলবে...