সাইকেলে মাধবপুরের জঙ্গলে
ওদের চোখে আমরা এলিয়েন টাইপের কিছু। যেন এইমাত্র স্পেসশিপে করে ল্যান্ড করেছি। আমাদের জিনিসপত্রও নেড়েচেড়ে দেখল তারা। যা হোক, লিক সারিয়ে আবার রওনা দিলাম। চা বাগানের আরও গভীরে ঢুকে যাচ্ছিলাম আমরা। দারুণ লাগছিল সবার, এটা বলতে হবেই। এর মধ্যে আবার শুরু হলো ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি। পাত্তা দিলাম না। কিন্তু কিছুক্ষণ চালানোর পর শ্রীমঙ্গলের ঐতিহ্য অনুযায়ী আবার আমার ট্রেকের চাকা লিক। যাক এবার আর লিক সারাই নয়, সঙ্গে আনা নতুন টিউবটা লাগিয়ে নিলাম।
এর মধ্যেই আবার ঝিরঝির করে বৃষ্টি শুরু হলো। দ্রুত চালিয়ে আমরা আশ্রয় নিলাম বাগানের আউট হাউসে। ওখানে দেখলাম কুলিরা চা পাতা তুলে এনে কুলি সর্দারের কাছে জমা দিচ্ছে। আর সর্দারও ওজন করে হিসাব লিখে রাখছে। কাজ শেষে চা শ্রমিকেরা দেখলাম চা পাতা দিয়ে বানানো ভর্তাজাতীয় কী একটা খাবার খাচ্ছে। শুনলাম এটা ওদের নিয়মিত খাবার চা পাতা, কাঁচালঙ্কা, পেঁয়াজ আর চানাচুর একসাথে মিশিয়ে বানায় ওরা। দেখে খেতে ইচ্ছে করল। যা-ই হোক, বৃষ্টি থামার সাথে সাথেই আবার আমরা রওনা দিলাম দুরন্ত গতিতে।
এবার অলকদা আমাদের নিয়ে গেল শ্রীমঙ্গলের একমাত্র গলফ কোর্সে। যদিও পরিত্যক্ত, তার পরেও গলফ কোর্স তো। ঢালু পাহাড়ি এলাকা। মজা করে কিছুক্ষণ আপহিল ডাউনহিল চালিয়ে নিলাম আমরা ওখানে। ফাঁকে ফাঁকে চলছে ছবি তোলা। একটা কথা বলি, তোমরা যারা ভবিষ্যতে শ্রীমঙ্গল যাবে সাইকেল নিয়ে, ওই জায়গাটায় অবশ্যই যেও একবার। মাউন্টেইন বাইকিংয়ের আপহিল ডাউনহিল মারার জন্য দুর্দান্ত একটা জায়গা। সকালের রাইডটা কাটল দারুণ মজায় এবার আমরা শ্রীমঙ্গল শহরের পথ ধরলাম। চলে এলাম পানসি রেস্টুরেন্টে মধ্যাহ্ন ভোজের জন্য। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় চিকেন বিরিয়ানি, ফিরনি ও বোরহানি দিয়ে খাওয়াটা হলো র্দুদান্ত। খাওয়ার পর ছক কাটতে বসলাম রাতে আমরা কোথায় থাকব। অনেক জল্পনা-কল্পনার পর সিদ্ধান্ত হলো মাধবপুর চা বাগানে যাব। বাগানের ম্যানেজার খোকনদার পরিচিত।
ওখানে পাহাড়ের ওপর একটি লেক আছে। চারপাশের দৃশ্যও অসাধারণ। সীমান্তের ওপারে ভারতের এলাকাও দেখা যায়, তবে অনুমতি সাপেক্ষে। অনুমতি পেলে আমরা সেখানে তাঁবু খাটিয়ে রাত্রিবাস করতে পারব। আগেই বলেছি, তাঁবু আমরা ঢাকা থেকে নিয়ে গিয়েছিলাম। এবার আমরা সাথে নিলাম শ্রীমঙ্গলের দুর্দান্ত ক্যাম্পার খোকন তানুজম ভাইকে। উনি পেশায় ফটোগ্রাফার, কিন্তু সুযোগ পেলেই বেড়িয়ে পড়েন বাইক নিয়ে সারাক্ষণ অ্যাডভেঞ্চারের জন্য মুখিয়ে আছে। এবার শুরু হলো আমাদের মূল রাইড। পিঠে সবারই ব্যাকপ্যাক। তার পরেও যত দ্রুত সম্ভব চালাচ্ছিলাম। চা বাগানের টিলাগুলোর মধ্য দিয়ে সাই সাই করে যাচ্ছিলাম। কিছু কিছু ডাউনহিল খুবই বিপজ্জনক। ঘড়িতে দেখলাম ৫টা বাজে। অসাধারণ সুন্দর ট্রেইলে আমাকে হঠাৎ গতির নেশায় পেয়ে বসল। দ্রুত প্যাডেল মারতে লাগলাম। ফলে কিছুক্ষণের মধ্যেই হারিয়ে ফেললাম সবাইকে।
এদিক-ওদিক কোনও ট্রেইলেই কাউকে খুঁজে পাচ্ছি না। এদিকে, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হবে হবে করছে। আন্দাজে ভর করে দ্রুত গতিতে সাইকেল চালাতে লাগলাম। বুঝতে পারলাম যে আমি লাউয়াছড়া বনের আশপাশে কোথাও আছি। সবাইকে হারালেও সাহস হারালাম না, একটা বড় ট্রেইল ধরে যেতে থাকলাম। একটা ট্রেইলের মধ্যে দেখলাম কয়েক জন, অলোকদা সাবল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তারা চিৎকার করে আমাকে একদিকে যেতে বলল। কিন্তু তাদের চেহারা দেখে সুবিধের মনে না হওয়ায় অন্য রাস্তা ধরলাম। প্রায় ৩০ মিনিট চালানোর পরে দেখলাম একটা চা বাগানের ফ্যাক্টরি। ওখানে একজন আমাকে বলে দিল মাধবপুর যাওয়ার পথ। ধড়ে যেন জান ফিরে পেলাম। তার পর বাকিটা সহজে চালিয়ে মাধবপুর পৌঁছালাম।
মূল ফটকের সামনেই দেখি সবাই দাঁড়িয়ে আছে। কী যে ভালো লাগল সবাইকে দেখে। তারা নাকি ভেবেছে যে আমি আগেই চলে এসেছি। যা হোক, সাইকেল পার্ক করে বিশ্রাম নিতে নিতে বিকেলের নাশতা করলাম বাগানেরই আনারস, পেঁপে আর কলা দিয়ে। ট্যুরিস্ট স্পট বলে তারা হয়তো দাম বেশি রাখল। এর মধ্যে সন্ধ্যা হয়ে এলো। একটু পর সুখবর পেলাম বাগানের ম্যানেজার আমাদের বাগানে রাত কাটানোর অনুমতি দিয়েছেন। কিন্তু বিপত্তি হচ্ছে, আবার টিপ টিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছে। তাই দেখে কয়েক জনের ক্যাম্পিংয়ের সাধ উবে গেল। মানে মানে ফিরে গেল তারা সাইকেল নিয়ে। মানিক ভাইকে তো বহু অনুরোধ করেও রাখা গেল না। আমরাও দোনামোনা করছিলাম। কিন্তু খোকনদার সাহস ও দৃঢ়সংকল্প দেখে মনস্থির করে ফেললাম থাকার জন্যই। আর গুগলে ওয়োদার রিপোর্ট দেখলাম, বলছে আজ রাতে তেমন বৃষ্টি হবে না। আশা জাগল মনে। একটু পর বাগানের মালি ও বাবুর্চি আসলে তাদের রাতের খাবারের জন্য বাজার করতে পাঠিয়ে দেওয়া হলো টাকা দিয়ে। ছোটন হলো আমাদের এই ট্যুরের ফান্ড ম্যানেজার। তাই সবাই ওর কাছে চাঁদার টাকা বুঝিয়ে দিলাম।
লেকের উত্তর-পূর্ব পাশে সুন্দর একটা টিলার ওপর আমরা একে একে চারটি তাঁবু খাটিয়ে ফেললাম। মাথার ওপর বড় বড় ছাতিম, গর্জন ও আরও নাম না জানা গাছ, তিন দিকে লেক। এগুলোকে শেড ট্রি বলে। আমার তো তাঁবুবাস বা তাঁবু খাটানোর অভিজ্ঞতা নেই, তাই আমি ছোটনকে সাহায্য করতে লাগলাম তাঁবু খাটোনোর ব্যাপারে যতটা পারি। ব্যাপারটা সহজ, তবে একটু মনোযোগ দিয়ে করতে হয়। সন্ধ্যা হয়ে গেছে আগেই। প্রচণ্ড পরিশ্রান্ত লাগছিল সারা দিন ঘোরাঘুরির পর। তাই আমি আর হাসিব ভাই নেমে পড়লাম মাধবপুর লেকের ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করতে। দুর্জয় ছোটন সাঁতার পারে না। ওদের বললাম, পাড়ে বসেই গোসল করো। গোসল করার পর দারুণ ফ্রেশ লাগল। শরীর একেবারে চাঙা। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই লেকের পানি আমরা পরে খেয়েওছিলাম। আসছি সে কথায় পরে।
চলবে...