সাইকেলে মাধবপুরের জঙ্গলে
দেখলাম, কাছেই একটি খাবারের হোটেলে গরম গরম পরোটা ভাজা হচ্ছে, সাথে ডাল ভাজি মিষ্টি আর দই। ব্যস, আর কী চাই। সবাই বসে পড়লাম পেটপুজোয়। বৃষ্টি থামার পর আলো ফুটলে আমরা চলে আসলাম পানসি রেস্টুরেন্টের সামনে। কিছুক্ষণ পর শ্রীমঙ্গল সাইক্লিস্টসের অলকদা খোকনদারা চলে আসলেন। সবার সঙ্গে পরিচিত হয়ে আমরা আরেক দফা নাশতা করলাম স্পেশাল চিকেন ভুনা খিচুড়ি দিয়ে।
খেতে খেতে অলকদা দুঃসংবাদ দিলেন, অতিরিক্ত বৃষ্টির দরুণ সাতছড়ি ট্রেইল যাওয়া যাবে না। ওটা এখন বৃষ্টির পানি আর কাদায় দুর্গম হয়ে পড়েছে। অন্য কোনও রুট বাছতে হবে। মন খারাপ হয়ে গেল সবার। ভেবেচিন্তে শেষে সিদ্ধান্ত হলো, আমরা সকালে ঘুরব শ্রীমঙ্গলের আশপাশে চা বাগান, সেমিট্রি, গলফ কোর্সে। এগুলো সাধারণ ট্যুরিস্টদের নাগালের বাইরে।
যা-ই হোক, আর বেশি দেরি না করে চা খেয়ে আমরা রাইড শুরু করলাম। এক ফাঁকে আমি সাইক্লিং ডেটা রেকর্ডিং অ্যাপটা চালু করে দিলাম, যাতে সাইক্লিং কমপিটিশন চ্যালেঞ্জে একটু এগিয়ে থাকতে পারি। বৃষ্টি থেমে গেছে। রোদ ওঠায় রাস্তাও কিছুটা শুকিয়েছে। তাই বেশ ভালোই চালাচ্ছিলাম আমরা। আর তা ছাড়া এই সাইকেলগুলো এ সমস্ত ট্রেইলে চালানোর জন্যই বানানো হয়েছে। বাতাস কেটে সাইসাই করে যাচ্ছে আমাদের মাউনটেন বাইকগুলো। এটা রোলিং কান্ট্রি, তাই সবাই আমাদের গিয়ার সিফট করে ১*৩ নিয়ে গেলাম চালানোর সুবিধার্থে। আমারটা ট্রেক ৪৩০০, ছোটনের লাল রঙের মেরিডা ৩২০ সাইকেল ব্র্যান্ড, হাসিব ভাইয়ের দুর্ধর্ষ ফরম্যাট আর দুর্জয়ের সাইকেল ব্র্যান্ড ল্যানডাওয়ে তছনছ হয়ে যাচ্ছিল শ্রীমঙ্গল ট্রেইলের মাটি।
ল্যানডাও নামটা শুনে আমার বার বার মনে হতো ল্যাটাও (শুয়ে থাকা); হা হা হা। কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছালাম ব্রিটিশ আমলের তৈরি করা কবরখানায়। চা বাগানের ব্রিটিশ ম্যানেজার ও তাদের পরিবার-পরিজনদের জন্য তৈরি হয়েছিল এই কবরখানা, উনিশ শতকের গোড়ায়। দেখে ছোটবেলায় পড়া ব্রাম স্টোকারের কাউন্ট ড্রাকুলা গল্পের কথা মনে পড়ে গেল। মৃতদের এখানে সবাই সাদা চামড়া আর কি! সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে বড় এপিটাফ। দেখলাম মোটেই অবহেলিত নয়। ভালোই রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে। ব্রিটিশ বলে কথা। এর পর গেলাম জেরিন টি-এস্টেটে। সাজানো-গোছানো টিলা আর চারপাশে চা বাগান সবুজ আর সবুজ। চায়ের পাতায় বৃষ্টির পানি আর রোদ পড়ে চিকচিক করছে। সার দিয়ে কাজ করছেন চা বাগানের কুলিরা। মেয়েরাই বেশি। সবকিছু দেখে নিমিষেই ভুলে গেলাম শহরের কর্মব্যস্ত জীবন। দুর্জয় আবার কিছুক্ষণ পর পর ছবি তুলছে। এমনকি চা বাগানের মেয়েদের সঙ্গে সেলফি তোলা ও গল্প করাও সারা।
আবার চলা শুরু করতেই বিপত্তি। আমার ট্রেক বাবাজি শুয়ে পড়ল। কেন? চাকা লিক। কী আর করা, গ্রামের বাজারের মতো জায়গায় থামলাম লিক সারানোর জন্য। প্যাচকিট পাম্পার আর এক্সট্রা টিউব সাথেই ছিল। লং রাইডে এগুলো আমাদের সাথেই থাকে। লিক সারাতে সারাতে শুনলাম শ্রীমঙ্গল নাকি ট্রেক বাইকের জন্য অপয়া। এর আগের ট্রিপে ওর ভাই রায়হান সবুজের ট্রেকও দুবার লিক হয়েছিল। এর মধ্যে দেখি সারা গ্রাম ভেঙে পড়েছে আমাদের দেখতে। পাঁচ বছরের শিশু থেকে ৬০ বছরের বুড়ো সবাই রয়েছে। চোখে তাদের বিশ্বের বিস্ময়।
চলবে...