সাইকেলে মাধবপুরের জঙ্গলে
লোকালয়ের বাইরে হওয়ায় দূষণমুক্ত। ইতোমধ্যে দেখি খোকনদা আর বাগানের মালি মিলে বনফায়ার জ্বালিয়ে ফেলেছে। বড়সড় অগ্নিকুণ্ড একটি। আমরাও চারপাশ থেকে শুকনো কাঠকুটো এনে ফেলতে লাগলাম আগুনটাকে বড় করার জন্য। তারপর গোল হয়ে বসলাম সবাই আগুনের পাশে। হাসিব ভাই আর খোকনদা হ্যামক ঝুলিয়েছে গাছে, মজা করে দোল খাচ্ছে তাতে। শুরু হলো আড্ডা ও গল্প। কীভাবে কীভাবে যেন ভূতের গল্প চলে আসল। একদিকে গহিন জঙ্গল পাহাড় আর লেকের জনমানবহীন অন্ধকার পরিবেশ, সব মিলিয়ে গা ছমছম করা পরিবেশ। বাগানের লোকগুলোও দেখি কখন যেন চলে গেছে। অতঃপর বাধ্য হয়েই ভূতের গল্প থামিয়ে সাইকেল ভ্রমণের গল্প করতে হলো।
দেখতে দেখতে রাত ৯টা বেজে গেল। বাগানের বাবুর্চি এখনও বাজার করে ফেরেনি। ব্যাটা কী করছে কে জানে। এদিকে খিদেয় সবারই পেট চোঁ চোঁ করছে। সবার ব্যাগ ঝেড়ে বেরোলো এক প্যাকেট চিপস, চানাচুর আর হাফ লিটার কোকাকোলা। নিমিষেই হারিয়ে গেল সেটা আমাদের পেটে। খিদের চোটে লেকের ধারে হাঁটাহাঁটি করতে গিয়ে আবিষ্কার হলো লেকের মধ্যে অনেক মাছ বিশেষ করে চিংড়ি মাছ আছে। ব্যস, আর যায় কোথায়। জেলে হয়ে গেলাম। সবাই মিলে বেশ কিছু মাছ ধরে ফেললাম। পরে সেই মাছ সেদ্ধ করে খেয়েছিলাম। একটু পর দেখি বাগানের বাবুর্চি বাজার করে ফিরেছে। এসেই ও আরেকটি চুলা ধরিয়ে ফেলল। শুরু করল রান্নার আয়োজন। খুশিতে আমরা আবার আড্ডায় মজে গেলাম। সবার অনুরোধে দুটো গানও গেয়ে ফেললাম আমি। রাত বাড়তে লাগল এবং এক সময় শেষ হলো রান্না। লেক থেকে সবাই যার যার ওয়াটার বটল ভরে নিয়ে আসলাম ভাত খাওয়ার জন্য। আয়োজন খুব বেশি না; সাদা ভাত, কষা মুরগির মাংস, ডাল আর সালাদ। বাবুর্চির রান্নার হাত মন্দ না। পরিবেশের কারণে সেটা আরও ভালো লাগল খেতে। একেবারে পেট পুরে খেলাম সবাই। খেতে খেতেও অনেক ক্ষণ গল্পগুজব চলল।
অনেকেরই ঘুম পেয়েছে। কিন্তু খোকনদা বলল, এত তাড়াতাড়ি ঘুমানো যাবে না। তাই আড্ডা চলতে থাকল। রাত এখন গভীর। ঠাণ্ডাও লাগছে বেশ। যা-ই হোক, একসময় আসর ভাঙল। অলকদা সবার আগে, তার পর সবাই ধীরে ধীরে তাঁবুর ভেতরে ঢুকে পড়লাম। বাবুর্চি আর ওর ছেলেটা তাদের নিজেদের তাঁবুতে আর আমরা আমাদের ক্যাম্পিং ট্যান্টে ঢুকে পড়লাম। মালি বলল সে সারা রাত জেগে পাহারা দেবে, বাগানের ম্যানেজারের কড়া নির্দেশ আছে আমাদের যাতে কোনও সমস্যা না হয়। তাই নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাতে গেলাম। দারুণ লাগছিল। নিস্তব্ধ পাহাড়ি রাত। নিশাচর পাখি আর দূরে শিয়ালের ডাক ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। জীবনে এই প্রথম সত্যিকারের পাহাড়ি জঙ্গলে তাঁবুবাস। সত্যিকারের অ্যাডভেঞ্চার । শুয়ে শুয়ে টের পেলাম ট্যান্টের গায়ে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে। মাধবপুরে এই পাহাড়ি লেকে শুধু এখন আমরাই আছি। ছোটন গল্প করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে। বেশ শীত লাগছিল, তাই উঠে রেইনকোটটা পড়ে নিলাম। ব্যাকপ্যাকটাকে বালিশ বানিয়ে শুয়ে পড়লাম। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি টেরই পাইনি।
ঘুম ভাঙার পর দেখি সকাল হয়ে গেছে। বনফায়ারটা এখন নিবু নিবু হালকা ধোঁয়া উঠছে তা থেকে। ছোটন আমার আগেই উঠে ফটোগ্রাফি করতে লেগে গেছে। তার ফেসবুকে প্রচুর ফলোয়ার। ঘণ্টায় ঘণ্টায় বিডিসাইকেলিস্ট ফেসবুক পেজে পোস্টিং না দিলে কি চলে। বাকিরা এখনও তাঁবুর মধ্যে ঘুমাচ্ছে। অতঃপর হাতমুখ ধুয়ে আমিও তাঁবু ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম পাহাড়ি ট্রেইলে মর্নিং ওয়াক করতে। দারুণ লাগছিল পাহাড়ি পথ ধরে হাঁটতে। এ তো আর বান্দরবানের বিশাল পাহাড় না যে উঠতে বেশি কষ্ট হবে। আর এত ভোরে মাধবপুরেও ট্যুরিস্ট আসে না; তাই শান্তিমতো ঘুরে দেখতে লাগলাম। সবচেয়ে উঁচু থেকে দেখলাম ভারতের সীমানা আর বাঁ দিকে জুরি ফরেস্ট রেঞ্জ। অনেক গভীর বন এটি। বুনো কিছু ট্রেইল আছে এখানে, যা বাংলাদেশ পেরিয়ে ভারতের ত্রিপুরা বা আসামে ঢুকে গেছে। কখন যে দুই ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে টেরই পাইনি। এই হচ্ছে সুন্দর পাহাড় জঙ্গলের প্রভাব।
সম্বিত ফিরল ট্যুরিস্ট আসার শব্দে। ধীরে ধীরে ফিরে এলাম ক্যাম্পে। আসার পথে দেখলাম দুর্জয় যথারীতি একটি গ্রামের মেয়ের সাথে গপ্প জুড়ে দিয়েছে। ধন্যি ছেলে যা হোক! বাকিরা উঠে গেছে ইতোমধ্যে। বাবুর্চি চা এনে দিল। সাথে পেলাম চা পাতা ভর্তা। জিনিসটা কচি চা পাতা, কাঁচামরিচ, চানাচুর, পেঁয়াজ মিশিয়ে বানানো। দুর্দান্ত খেতে। আমরা কাড়াকাড়ি করে খেলাম। চা পর্বের পর আমরা ফটোগ্রাফি সেশন করে নিলাম। আপহিল ডাউনহিল ক্যাম্পসাইট, সবকিছুর ছবি তোলা হলো। কিছু অভিনয় করারও দরকার হলো। বাবুর্চি নাশতা খেতে ডাক দিল। খিচুড়ি ও ডিম ভাজা। আহা, মজা করে খেলাম সবাই। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে তাঁবুটাবু গোছগাছ করে ফিরতি পথ ধরলাম লাউয়াছড়া বনের ভেতর দিয়ে। অলকদা ও খোকনদার এই এলাকা ভালোমতো চেনা। তাই ধীরেসুস্থে মজা করে চালাচ্ছিলাম। বনের মধ্যে কোথাও দেখলাম ঝিরিপথ, কোথাও পাথর বিছিয়ে আছে। পুরোটাই অফরোড আর উঁচুনিচু, তাই সবাই সাইকেলের গিয়ার ১*৩-এ করে নিয়েছি। বেশ কয়েকটা পুল পেরোলাম আমরা। পথে একটা জায়গায় আনারসের বাগান থেকে আনারস ও লেবু কিনলাম। বাগানেই কেটে খেলাম কয়েকটা। খুবই মিষ্টি আর রসাল। এর পর আর বিরতি না দিয়ে চা বাগানের ভেতর দিয়ে পৌঁছে গেলাম শ্রীমঙ্গল।
বৃষ্টি আর আসেনি, ঘড়িতে বাজে বেলা ১২টা। আবার গেলাম সবাই পানসীতে। শেষের খাবারটা জম্পেশ করার জন্য সবাই চিকেন বিরিয়ানি কোল্ড ডিংকস ও ফিরনি দিয়ে লাঞ্চ সারলাম। লাঞ্চের পর খোকনদা ও অলকদাকে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় দিলাম। তাদের সার্বিক সহায়তা ছাড়া এ ট্যুরটা কখনওই সম্ভব হতো না। কথা দিলাম আবার আসব আমরা। ফিরতি যাত্রাটা আরও স্মরণীয় করার জন্য ট্রেনের টিকিট কাটার চেষ্টা করলাম। আমি জানতাম শ্রীমঙ্গল থেকে ৫টায় পারাবত এক্সপ্রেস আছে, যেটা রাত ৯টায় ঢাকা কমলাপুর পৌঁছায়। কিন্তু টিকিট পেলাম মাত্র দুটো আর আমরা চার জন। তাই বাধ্য হয়ে বাস লাভার ছোটনের পরামর্শে আমরা ট্রেন ছেড়ে বাসেই ঢাকার পথে রওনা দিলাম। রাত ৯টার মধ্যেই পৌঁছালাম ঢাকার স্টাফ রোডে। ছোটনের বাসা কাছেই, সে ফুর্তিতে নেমে গেল তার সাইকেল নিয়ে। এদিকে, জ্যাম লেগে গেছে। গাড়ি আর এগোয় না। এক ঘণ্টা দেখে আমরাও বাস থেকে বিরক্ত হয়ে নেমে পড়লাম। বিপত্তিতে পড়লাম বাগান থেকে কেনা আনারসগুলো নিয়ে। শেষে ওগুলোকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ঝুলিয়ে নিলাম সাইকেলের হ্যান্ডেলে।
এমনিতেই রাত হয়ে গেছে, তাই সেখের জায়গা দিয়ে ত্রিমোহনীর দিকে এগোতে থাকলাম। ফাঁকা হাইওয়ে, আশপাশে বাড়িঘর তেমন নেই এই এলাকায়। ভয়-ভয় লাগছিল একটু। সম্ভাব্য ছিনতাইয়ের ভয়ে আমরা খুব দ্রুত চালাতে লাগলাম। এবড়োখেবড়ো রাস্তায় ঝাঁকিতে হাসিব ভাইয়ের আনারস ছিঁড়ে হারিয়ে গেল অন্ধকারে। কিন্তু দাঁড়ানোর সাহস করলাম না। ধীরে ধীরে পৌঁছালাম বাসাবো মাদারটেকের রাস্তায় আর সেইসাথে বিপদমুক্ত হলাম বলতে গেলে। দুর্জয় আর হাসিব ভাইকে খিলগাঁওয়ের রাস্তায় উঠিয়ে দিয়ে রাত ১১টায় আমিও বাসায় পৌঁছে গেলাম। আর এ ভাবেই সফলভাবে শেষ হলো আমাদের দুদিন দুরাতের অবিস্মরণীয় চা বাগান ক্যাম্পিং রাইড। ইচ্ছে আছে খুবই শিগগিরই আবার যাব মায়াবি শ্রীমঙ্গলে, সেই পাহাড়ি মাধবপুরের চা বাগান লেক আর জঙ্গলের ধারে। আসছে শীতকালেই। কি, যাবে নাকি আমাদের সাথে? তাহলে চোখ রেখো বন্ধুরা ফেসবুকের পাতায় আর চালাতে থাকো সাইকেল।