১১৫ বছরের বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে যা দেখবেন
বরেন্দ্র ভূমি, সিল্কের শহর, দেশের একমাত্র পরিচ্ছন্ন নগরী হিসাবে রাজশাহী শহরকে বিশেষায়িত করা যায়। রাজশাহীতে কী আছে, এমন প্রশ্নের উত্তরে সবার প্রথমে থাকে ‘বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর’। যদিও পূর্বে এর নাম শুধু ‘বরেন্দ্র জাদুঘর’ ছিল।
বাংলাদেশের প্রথম জাদুঘর এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহশালা এই বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর। যা এখনো প্রাচীন এবং দূর্লভ-দুষ্প্রাপ্য ঐতিহ্য বহন করে যুগের পর যুগ দাঁড়িয়ে আছে।
বরেন্দ্র অ লের পাল, সেন, মৌর্য ও গুপ্ত আমলসহ হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন সংরক্ষিত রয়েছে জাদুঘরটিতে। তাই নিয়মিত প্রচুর দর্শনার্থী প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের নিদর্শন দেখতে ঘুরতে আসেন বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে। দেশি-বিদেশি গবেষকরাও তাদের গবেষণা কাজে ছুটে আসেন এখানে।
ঐতিহ্যবাহী বরেন্দ্র জাদুঘরের ইতিহাস
১৯১০ সালে রাজশাহীর পার্শ্ববর্তী নাটোর জেলার দিঘাপতিয়ার রাজপরিবারের বিদ্যোৎসাহী জমিদার কুমার শরৎকুমার রায়, খ্যাতনামা আইনজীবী ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় এবং রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক রমাপ্রসাদ চন্দ্রের প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে বাংলাদেশের অন্যতম এই জাদুঘর।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ থেকে তৎকালীন সচেতন মহল ইতিহাস, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারের জন্য উৎসাহী হয়ে ওঠেন। ফলে বিস্মৃত প্রায় সাহিত্যিক নিদর্শন এবং ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো সংগ্রহ ও অনুশীলনের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে ১৯০৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের কাশিমবাজার পরিষদের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
পরের বছর অনুষ্ঠিত পরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশনে শরৎকুমার রায়, অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় ও রমাপ্রসাদ বরেন্দ্রভূমির পুরাকীর্তি সম্পর্কে জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এবং পুরাকীর্তি সম্পর্কে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। ১৯১০ সালে তারা বগুড়া জেলার খঞ্জনপুরে পুরাতাত্ত্বিক অভিযানে গিয়ে এর ঐতিহ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জন্য ‘বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি’ গঠন করেন। পরে এই সমিতি অনুসন্ধানে নেমে রাজশাহী জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে প্রথম কালো পাথরের বিখ্যাত গঙ্গা মূর্তিসহ পুরাতত্ত্বের ৩২টি দুষ্প্রাপ্য নিদর্শন সংগ্রহ করে। সমিতির সম্পাদক রামপ্রসাদ চন্দ প্রাপ্ত সমুদয় নিদর্শনগুলোকে তিন ভাগে বিভক্ত করেন।
সেগুলো হলো- পুরনো স্থাপত্যের নিদর্শন, পুরনো ভাস্কর্যের নিদর্শন ও পুরনো জ্ঞান ধর্ম সভ্যতার নিদর্শন।
পরবর্তীতে তাঁরা তিনজন মিলে সমিতির ব্যয় বহনের জন্য ব্যক্তিগত যে অর্থ দেন তা প্রয়োজনের তুলনায় কম ছিল। সে সময় বঙ্গীয় সরকার এ সমিতিকে ১০০ টাকা করে অনুদান দিত। ফলে এই আর্থিক টানাপোড়েনের মধ্য দিয়েই সংগৃহীত নিদর্শনগুলো সংরক্ষণ করতে একটি ভবন নির্মাণ করা জরুরি হয়ে পড়ে। তখন শরৎকুমার তাঁর বন্ধুদের অনুরোধে ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করেন। সমিতির কর্মকর্তাদের অনুরোধে ১৯১৬ সালের ১৩ নভেম্বর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন বাংলার গভর্নর লর্ড কারমাইকেল। নির্মাণ কাজ শেষ হলে ১৯১৯ সালের ২৭ নভেম্বর দ্বার উন্মোচন করেন লর্ড রোনাল্ডসে। ১৯১১ সালে কলকাতা জাদুঘর বরেন্দ্র জাদুঘরের যাবতীয় সংগ্রহ দাবি করলে এর অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। পরে ১৯১৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি সরকারি সার্কুলারের মাধ্যমে স্থানীয় জাদুঘরগুলোকে সংগ্রহের বিষয়ে স্বাধীনতা দেওয়া হলে এ জাদুঘরের অস্তিত্ব রক্ষা হয়।
১৯৪৭ সালের পর বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর মারাত্মক দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় পড়ে। যার ফলে এটি রক্ষা ও পুনর্গঠনের প্রয়োজনে ১৯৬৪ সালের ১০ অক্টোবর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করার পর এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্ত হয়।
যা আছে বরেন্দ্র জাদুঘরে
জাদুঘরের সংগ্রহে বর্তমানে পাণ্ডুলিপিসহ ১১ হাজার ৩৩১টি প্রত্ননিদর্শন ও ১৪ টি গ্যালারি রয়েছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে জাদুঘর থেকে বিভিন্ন সময়ে হারিয়ে গেছে প্রায় তিন হাজার দুর্লভ প্রত্নসামগ্রী। তবে জাদুঘরের এ পর্যন্ত সংগ্রহ সংখ্যা সাড়ে আট হাজারেরও বেশি। এর মধ্যে প্রায় দেড় হাজার প্রস্তর ও ধাতবমূর্তি, ৬১টি লেখচিত্র, দুই হাজারেরও বেশি প্রাচীন মুদ্রা, ৯০০’র বেশি পোড়ামাটির ভাস্কর্য-পত্র-ফলক, প্রায় ৬০টি অস্ত্র-শস্ত্র, ৩০টির মতো আরবি-ফার্সি দলিল, মোগল আমল থেকে ব্রিটিশ আমল পর্যন্ত বিভিন্ন প্রকারের রৌপ্য-ব্রোঞ্জ-মিশ্র ধাতুর প্রায় ৪০০টি মুদ্রা রয়েছে এখানে। এছাড়া প্রায় সাড়ে চার হাজারেরও বেশি পাণ্ডুলিপি আছে। এসব সংগ্রহ মোট ১৪টি গ্যালারিতে দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত।
বরেন্দ্র জাদুঘরের এক নম্বর গ্যালারিতে রয়েছে প্রচীন আমলের ঢাল-তলোয়ার, ধাতবপাত্র, মহেঞ্জোদারো ও মহাস্থানের বিভিন্ন নিদর্শন। সম্রাট অশোক থেকে ব্রিটিশ আমল পর্যন্ত কাঠ, পাথর ও অন্য বস্তু দ্বারা নির্মিত মূর্তিগুলো প্রদর্শিত হয়। দুই নম্বর গ্যালারি সূর্য, বিষ্ণ, শিব, কার্তিক ও অন্য দেবতার মূর্তি, পার্বতী, সরস্বতী, মনসা দুর্গা ও অন্য দেবীর মূর্তি। তিন নম্বর বুদ্ধ গ্যালারিতে সব বুদ্ধ দেব-দেবী ও জৈন মূর্তি, বোধিসত্ত্ব, ঋসভনাথ, পর্শ্বনাথ ইত্যাদি প্রদর্শিত হয়।
এছাড়া সেখানে প্রাচীন আমলের আরবি, ফার্সি, সংস্কৃত, বাংলা লেখচিত্র এবং পাল যুগ, সুলতানি যুগ, মোগল যুগের শিলালিপি ছাড়াও শেরশাহর দু’টি কামান ও মেহরাব প্রদর্শিত হচ্ছে। চার নম্বর ইসলামী গ্যালারিতে হাতে লেখা কোরআন শরীফ, মোগল আমলের ফার্সি দলিল, পোশাক মুদ্রা ইত্যাদি দিয়ে এ গ্যালারি প্রাচীন ঐতিহ্য প্রদর্শন করা হচ্ছে।
বর্তমানে পাঁচ নম্বর আবহমান বাংলা গ্যালারিতে প্রদর্শন করা হচ্ছে বাঙালি জাতির ব্যবহার্য জিনিসপত্র, প্রাচীন গহনা, দেশি বাদ্যযন্ত্র, আনুষ্ঠানিক মৃৎপাত্র, উপজাতিদের ব্যবহার্য জিনিসপত্র। কিশলয় বেষ্টিত নদীমাতৃক বাংলার নৌকার মডেল, অস্ত্রের সূর্য নরম সোনালি রোদ ছড়িয়ে জন্মভূমিকে করেছে অপরূপ সৌন্দর্য। এখানে সেই চিত্র ফুটে ওঠে।
জাদুঘর পরিদর্শনের সময়সূচি
বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর প্রতি শনিবার থেকে বুধবার সকাল ১০ টা থেকে বিকেল ৫ টা পর্যন্ত খোলা থাকে৷ বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘোষিত ছুটির দিনগুলোতে জাদুঘরটি বন্ধ থাকে৷
যেভাবে যাবেন
সড়ক, রেল ও আকাশপথে রাজশাহীতে পৌঁছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বা রিকশায় করে খুব কম সময়ে পদ্মা নদীর টি-বাঁধে আসা যায়। ঢাকা থেকে প্রতি আধা ঘণ্টা পর পর রাজশাহীর উদ্দেশে বাস ছেড়ে আসে। দেশ, গ্রামীণ, হানিফ ট্রাভেলস ও শ্যামলী করে আসতে পারেন। নন-এসি বাসের জন্য বর্তমানে আপনাকে ৭১০ টাকা ভাড়া গুণতে হবে। বাসভেদে এসি বাসের ভাড়া ১৪০০ টাকার কম-বেশি৷
এ ছাড়া রেলপথে আসতে চাইলে ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে সিল্কসিটি, পদ্মা, ধুমকেতু ও বনলতা এক্সপ্রেস ট্রেন ছেড়ে আসে। বনলতায় শোভন চেয়ার টিকেটের মূল্য ৩৭৫ টাকা ও অন্যগুলোতে ৩৪০ টাকা। রেলের ক্ষেত্রে এসি বার্থ বা স্লিপারের জন্য প্রায় ৬০০ থেকে এক হাজার টাকারও বেশি ভাড়া দিতে হবে। এ ছাড়া কেউ চাইলে বিমানযোগে রাজশাহীর শাহ মখদুম বিমানবন্দরে এসে নামতে পারেন। সেখান থেকে অটোতে করে রাজশাহী শহরে আসা যাবে।
থাকবেন যেখানে
রাজশাহীতে রাত্রিযাপন করতে হোটেল ভেদে ২০০ থেকে চার হাজার টাকায় বিভিন্ন মানের রুম পাওয়া যাবে। রাজশাহীর বিভিন্ন হোটেলগুলোর মধ্যে রয়েছে রাজশাহী পর্যটন মোটেল, সাহেব বাজারে হোটেল মুক্তা ইন্টারন্যাশনাল, বিন্দুরমোড় রেল গেইটে হোটেল ডালাস ইন্টারন্যাশনাল, গণকপাড়ায় হোটেল নাইস ইন্টারন্যাশনাল, মালোপাড়ায় হোটেল সুকর্ণা ইন্টারন্যাশনাল, সাহেব বাজারে হামিদিয়া গ্রান্ড হোটেল, শিরোইলে হকস্ ইন, লক্ষ্মীপুর মোড়ে হোটেল গ্যালাক্সি ও সাহেব বাজারে হোটেল নিউ টাউন ইন্টারন্যাশনাল।