শঙ্কা, যুদ্ধ, বিক্ষোভ আর আশা নিয়ে ঘটনাবহুল বছর
ঘটনাবহুল একটি বছর ২০২০ সাল। এর মধ্যে করোনা মহামারিতে মৃত্যু আর আতঙ্ক, ভ্যাকসিন আবিষ্কার, ভাইরাসটি নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, বিভিন্ন ইস্যুতে নানা দেশে আন্দোলন আর বিক্ষোভ এ বছরটিকে করে তুলেছে আরো বেশি ঘটনাবহুল।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর থেকে প্রথম নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে। শহরটির একটি সামুদ্রিক খাবার ও পশুপাখির বাজারের সঙ্গে করোনার প্রথম সংক্রমণের সম্পর্ক রয়েছে বলে জানা যায়।
প্রথমদিকে করোনাভাইরাসজনিত রোগটির নির্দিষ্ট কোনো নাম ছিল না। বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে রোগটিকে ব্যাখ্যা করতে থাকে। পরে ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ রোগটির আনুষ্ঠানিক নাম দেয় ‘কোভিড-১৯’। এটি ‘করোনাভাইরাস ডিজিজ ২০১৯’-এর সংক্ষিপ্ত রূপ।
এরপর গত ১১ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবকে বিশ্ব মহামারি ঘোষণা করে।
এখন পর্যন্ত প্রাণঘাতী এই ভাইরাস সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে কেড়ে নিয়েছে বহু জীবন। এ ছাড়াও অনেকেই এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর ভুগছেন বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায়।
ভাইরাসের বিস্তার মোকাবিলায় লকডাউন, বিধিনিষেধ ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেখা দিয়েছে অর্থনৈতিক মন্দা। কর্মহীন হয়ে পড়েছে অনেক মানুষ।
ধারণা করা হচ্ছে, করোনা মহামারি নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও বিশ্ব অর্থনীতির যে ক্ষতিসাধন হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠলে লাগবে বহু বছর।
ভাইরাসটি নিয়ে বছরজুড়ে বিতর্ক কম ছিল না। এ ছাড়া ভাইরাসটি মোকাবিলায় নানা রকম ভ্রান্ত বিশ্বাস আর প্রতিষেধক নিয়ে চলেছে জল্পনা-কল্পনা। বিশ্ব নেতারা এই ভাইরাস মোকাবিলায় কতটুকু সমন্বয় সাধন করেছে, চীন-যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈরথ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিভিন্ন বক্তব্য ঘিরেও বিতর্কের শেষ ছিল না। এ ছাড়া ভাইরাসটি বাজার থেকে নাকি গবেষণাগার থেকে ছড়িয়েছে, তা নিয়েও চলেছে নানা জল্পনা কল্পনা। আর এজন্যই ভাইরাসটি উৎস উহান শহর থেকেই হয়েছে কি না, সেজন্য তদন্তের ভার কাঁধে নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। যদিও শুরুর দিকে চীনা সরকার এই তদনের অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহী দেখায়নি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, ১০ জন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ নিয়ে গঠিত তদন্ত দলটি আগামী জানুয়ারি মাসে চীনে যাবে।
ওই বিশেষজ্ঞ দলের এক সদস্য সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে জানিয়েছেন, করোনার উৎস নিয়ে কাউকে দোষ দিতে চাচ্ছে না বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বরং ভবিষ্যতে করোনার সংক্রমণ মোকাবিলা করতে চাচ্ছে।
তদন্ত দলের সদস্য জার্মানির রবার্ট কোচ ইনস্টিটিউটের ফ্যাবিয়ান লিন্ডার্টজ বলেছেন, ‘করোনার উৎসের জন্য কোন দেশ দায়ী, তা খুঁজতে এই তদন্ত করা হচ্ছে না। মূলত কী ঘটেছিল, তা জানার পর পাওয়া তথ্য-উপাত্ত নিয়ে ভবিষ্যতে আমরা ঝুঁকি কমাতে পারি।’ চার থেকে পাঁচ সপ্তাহ ধরে এই তদন্তের কাজ চলতে পারে বলে জানিয়েছেন ফ্যাবিয়ান।
এদিকে, তদন্ত চালাতে বেশ আগে থেকেই অনুমতি চেয়ে এসেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তবে, এতদিন গড়িমসি করার পর এবার মধ্যস্থতায় পৌঁছাল বেইজিং।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, করোনাভাইরাসের আবির্ভাবের পর এ পর্যন্ত এটি অন্তত ১৭ বার মিউটেশনের মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়েছে। অতি সম্প্রতি নতুন এবং আরো বেশি সংক্রামক করোনাভাইরাসের ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ায় উদ্বেগ বেড়েছে।
বৈরুত বিস্ফোরণ
লেবাননের রাজধানী বৈরুতের বন্দরে গত ৪ আগস্ট রাসায়নিক পদার্থের এক গুদামে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। এই বিস্ফোরণের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে স্তম্ভিত হয়ে যায় মানুষ। এটি ছিল এ শতাব্দীর ভয়াবহ এক বিস্ফোরণ।
বৈরুতের বন্দর এলাকায় বহু বছর ধরে মজুত রাখা প্রায় দুই হাজার ৭৫০ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের বিস্ফোরণে নিহত হন দুই শতাধিক মানুষ। এ ছাড়া আহত হন ছয় হাজারের বেশি মানুষ।
যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষক দল জানায়, ওই বিস্ফোরণের আনুমানিক শক্তি ছিল অন্তত ৫০০ টন টিএনটি বিস্ফোরকের সমান। যুদ্ধে ব্যবহৃত বোমায় যে বিস্ফোরক ব্যবহৃত হয়—তার সংক্ষিপ্ত নাম টিএনটি।
গবেষক দলের ড. স্যাম রিগবি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে জানায়, “ওই বিস্ফোরণ ছিল যুদ্ধে ব্যবহৃত ‘কনভেনশনাল’ বা প্রচলিত অস্ত্রের মধ্যে যেগুলো সবচেয়ে বড়—তার চেয়েও ১০ গুণ বেশি শক্তিশালী।”
জর্জ ফ্লয়েড হত্যা ও ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলন
যুক্তরাষ্ট্রের মিনিয়াপোলিসে পুলিশ হেফাজেতে এক কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন নাগরিক জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর ঘটনায় ২০২০-এ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলন। পুলিশি হেফাজতে থাকার সময় মারা যান ৪৬ বছর বয়সী ফ্লয়েড।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, প্রায় আট মিনিট ধরে ফ্লয়েডের ঘাড়ের ওপর হাঁটু গেড়ে চেপে ধরে রেখেছেন ৪৪ বছর বয়সী শ্বেতাঙ্গ সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা ডেরেক শভিন। জর্জ ফ্লয়েড দম নিতে না পেরে হাঁপাচ্ছেন, বারবার অনুনয় করছেন।
জর্জ ফ্লয়েড মৃত্যুর আগে যে তিনটি শব্দ উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন, তা তার মৃত্যু পর হয়ে ওঠে বিশ্বজোড়া এক আন্দোলনের মূলমন্ত্র ‘আই কান্ট ব্রিদ’, অর্থাৎ ‘আমি শ্বাস নিতে পারছি না’।
ভিডিওতে পুরো ঘটনার ছবি তোলেন পথচারী ১৭ বছরের তরুণী ডারনেলা ফ্রেজিয়ার।
পরে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত হন পুলিশ কর্মকর্তা ডেরেক শভিন। তাকে আদালতে নেওয়ার পর এক মিলিয়ন ডলারের জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়। আগামী বছর মার্চে বিচারের শুনানি হওয়ার কথা।
ওই সময়ে সেখানে উপস্থিত থাকা আরো তিনজন পুলিশ কর্মকর্তাকেও বরখাস্ত করা হয় এবং তাদের বিরুদ্ধে হত্যায় সহযোগিতার অভিযোগ আনা হয়।
জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর প্রতিবাদে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভ। করোনাভাইরাস আতঙ্ক উপেক্ষা করে মানুষ প্রতিবাদ সমাবেশ, মিছিল ও বিক্ষোভে নামে।
বিক্ষোভকারী ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণে আনতে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি শহরে জারি করা হয় কারফিউ। যুক্তরাষ্ট্রের সংরক্ষিত সামরিক বাহিনী, ন্যাশনাল গার্ডের সেনা মোতায়েনের ঘটনাও ঘটে।
যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক বর্ণবাদবিরোধী বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার পর পৃথিবীর নানা প্রান্তে শুরু হয় প্রতিবাদের ঢেউ। জন্ম নেয় বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’।
সমাজ ব্যবস্থা থেকে বর্ণবাদসহ সব ধরনের বৈষম্যের অবসানের দাবি তুলতে শুরু করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ। এর অনুষঙ্গ হিসেবে বিক্ষোভকারীরা যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনেক ঐতিহাসিক নেতা বা বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের ভাস্কর্য ভাঙচুর করে কিংবা সেগুলো উপড়ে ফেলে।
মার্কিন নির্বাচন
সারা বছর ধরে বিশ্বের নজর ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিকে, যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় গত ৪ নভেম্বর।
যুক্তরাষ্ট্রে ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে ঘিরে ছিল নজিরবিহীন সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভাজন। ফলাফল ঘোষণার পর্বও ছিল চরম নাটকীয়। ইলেকটোরাল কলেজের ভোটে এগিয়ে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন যখন দাবি করেন, তিনি জয়ের পথে রয়েছেন, তখন রিপাবলিকান ট্রাম্প ভোট জালিয়াতি ও ব্যালট চুরির অভিযোগ এনে দাবি করেন, নির্বাচনে তিনিই জয়ী হয়েছেন।
প্রচারের সময়ই ডোনাল্ড ট্রাম্প হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, নির্বাচনি ফলের ব্যবধান যদি খুব কম হয়, তিনি তার বিজয় ছিনিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে ডেমোক্র্যাটদের বিরুদ্ধে ভোট কারচুপির অভিযোগ আনবেন। কয়েক লাখ বৈধ ব্যালট গণনা বাকি থাকতেই তিনি নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করেন।
ট্রাম্পের ডেমোক্র্যাট প্রতিপক্ষ জো বাইডেনও বলেন, ‘প্রতিটি ভোট গণনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই নির্বাচন শেষ হবে না।’ তিনিও ভোট গণনার সময় জোর দিয়ে বলেছিলেন, ‘ডেমোক্র্যাটরা জয়ের পথে রয়েছে।’
ইলেকটোরাল কলেজের ভোটে জো বাইডেনের পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়া নিশ্চিত হয় গত ১৫ ডিসেম্বর। বাইডেন পান ৩০৬টি ইলেকটোরাল ভোট আর বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পান ২৩২টি।
নির্বাচনের পর থেকেই ট্রাম্প হুমকি দিয়েছিলেন যে, ফল নিয়ে তিনি সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হবেন। তিনি আইনি পদক্ষেপসহ মামলা করার মাধ্যমে নানাভাবে ফল পাল্টানোর চেষ্টা করেন।
তবে ইলেকটোরাল কলেজের ভোটের পর এখনো চুপ আছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। যদিও তিনি এখনো পরাজয় স্বীকার করেননি, বরং নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ অব্যাহত রেখেছেন। কিন্তু তাঁর মামলাগুলো একের পর এক বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের আদালতে খারিজ হয়ে গেছে।
ট্রাম্প শিবির বলছে, তাদের আইনি লড়াই চলতে থাকবে, এবং তারা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত যাবে। যদিও সুপ্রিম কোর্টে এরকম কোনো আপিল শোনা হবে কি না এবং তা নির্বাচনি ফল উল্টে দিতে পারবে কি না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
ভোটের ফল এখন ওয়াশিংটন ডিসিতে পাঠানো হবে এবং কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে আগামী ৬ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিক গণনা হবে। এটি আগামী ২০ জানুয়ারি বাইডেনের শপথ নেওয়ার পথ তৈরি করবে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এই প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়েছেন একজন নারী। শুধু নারী হিসেবেই নয়, কমলা হ্যারিস কৃষ্ণাঙ্গ ও দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়েও ইতিহাস তৈরি করেছেন।
ইসরায়েল ও মধ্যপ্রাচ্য সম্পর্কে নতুন মোড়
যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় গত ১৩ আগস্ট ইসরায়েল ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ঘোষণা ছিল মধ্যপ্রাচ্যের জন্য একটি ঐতিহাসিক ঘটনা।
নিউইয়র্ক টাইমসের বিখ্যাত কলামিস্ট টমাস এল ফ্রিডম্যান এই ঘোষণাকে ব্যাখ্যা করেন ‘মধ্যপ্রাচ্যের একটি ভূ-রাজনৈতিক ভূমিকম্প’ বলে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প এই চুক্তিতে মধ্যস্থতা করেছিলেন। পুরো আলোচনাটি চলেছিল এতটাই গোপনে যে, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যন্ত নাকি এ বিষয়ে কিছু জানতেন না।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে এই ঘোষণা দেওয়ার পরপরই ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু দিনটিকে ‘এক ঐতিহাসিক দিন’ বলে হিব্রুতে টুইট করেন।
এক যুক্ত বিবৃতিতে ইসরায়েল ও আরব আমিরাত জানায়, এই ঐতিহাসিক অগ্রগতি মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির অগ্রযাত্রায় সাহায্য করবে।
দুই দেশের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্কের বিনিময়ে ইসরায়েল পশ্চিম তীরের বিশাল ফিলিস্তিনি এলাকা ইসরায়েলের অংশ করে নেওয়ার কাজ আপাতত স্থগিত রাখবে বলে জানানো হয়।
এর এক মাস পরেই ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের ঘোষণা দেয় বাহরাইনও।
ইসরায়েলের জন্য এই দুটি আরব রাষ্ট্রের সঙ্গে হাত মেলানো ছিল সত্যিকার অর্থেই এক বিরাট অর্জন।
তবে, গত অর্ধশতাব্দী ধরে ইসরায়েলি দখলদারিত্ব ঘুচিয়ে স্বাধীন একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের প্রতি পুরো আরব বিশ্বের যে ঐক্যবদ্ধ সমর্থন ছিল, এই ঘোষণা আসে তার প্রতি একটি বড় আঘাত হিসেবে। ফিলিস্তিনিরা সংযুক্ত আরব আমিরাতের এই পদক্ষেপকে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ বলে মন্তব্য করে।
ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস নিন্দা জানিয়ে বলেন, ‘এটি জেরুজালেম, আল-আকসা ও ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা।’
এই দুই আরব রাষ্ট্রের ঘোষণার পর সৌদি আরবও ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে যাচ্ছে কি না, তা নিয়ে ছিল ব্যাপক জল্পনা।
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম হওয়ার পর বাহরাইন ও আরব আমিরাত তৃতীয় ও চতুর্থ উপসাগরীয় দেশ হিসেবে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিল। এর আগে মিশর ১৯৭৯ সালে এবং জর্ডান ১৯৯৪ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে।
যুদ্ধ
নাগোর্নো-কারাবাখ : পূর্ব ইউরোপে দক্ষিণ ককেশাসের বিরোধপূর্ণ এলাকাটিকে কেন্দ্র করে ২৭ সেপ্টেম্বর আবার যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে। এই এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুটো দেশের মধ্যে এর আগেও সংঘর্ষ হয়েছে। সমঝোতার মাধ্যমে ছয় বছর ধরে চলা যুদ্ধ ১৯৯৪ সালে থেমে গেলেও তাদের মধ্যে কখনো শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর হয়নি।
আন্তর্জাতিকভাবে এই এলাকাটি আজারবাইজানের অংশ বলে স্বীকৃত হলেও, আর্মেনিয়ার সরকারের সমর্থনে জাতিগত আর্মেনীয়রা এটি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। দুটো দেশই এলাকাটিকে তাদের নিজেদের অংশ বলে দাবি করে। রাশিয়ার মধ্যস্থতায় নভেম্বরে একটি শান্তি চুক্তি হলেও তা কার্যকর হয়নি।
ছয় সপ্তাহের বেশি চলা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে দুপক্ষের পাঁচ হাজারের বেশি সৈন্য প্রাণ হারিয়েছে।
ইথিওপিয়া : দেশটির সরকারি বাহিনীর সঙ্গে উত্তরে টিগ্রের ক্ষমতাসীন দল টিগ্রে পিপলস লিবারেশন ফ্রন্টের (টিপিএলএফ) মধ্যে নভেম্বর মাসে তীব্র লড়াই শুরু হয়।
ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যাবি আহমেদ টিগ্রের আঞ্চলিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে জানান, টিগ্রেতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর সেনা ঘাঁটিতে টিপিএলএফের হামলার জবাবে তিনি সামরিক আগ্রাসনের নির্দেশ দিয়েছেন।
টিপিএলএফ-এর নেতাদের সঙ্গে অ্যাবি আহমেদের তিক্ত সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। সাম্প্রতিক সংঘর্ষে শত শত মানুষ মারা গেছে এবং কয়েক হাজার মানুষ ঘরছাড়া হয়েছেন। সরকারি বাহিনী টিগ্রের ওপর স্থল ও বিমান আক্রমণ চালিয়েছে।
লিবিয়া : এই দেশটিতেও দীর্ঘদিন ধরে চলা অশান্তির আগুনে ভাটা পড়েনি। বর্তমানে লিবিয়ায় জাতিসংঘের সমর্থনপুষ্ট সরকার, বিদ্রোহী নেতা জেনারেল খালিফা হাফতারের বিদ্রোহী বাহিনীর সঙ্গে লড়ছে। লিবিয়ার পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলের বড় অংশ এই মুহূর্তে খালিফা হাফতারের বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে।
লিবিয়া নিয়ে ন্যাটো জোটভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে মতভেদ এবং লিবিয়ার বিবদমান দুপক্ষের পেছনে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এই সংকটকে আরো জটিল করে তুলেছে।
জেনারেল হাফতারের বাহিনীকে সহায়তা করছে রাশিয়া, মিশর, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। অন্যদিকে ত্রিপলি সরকারের পেছনে রয়েছে তুরস্ক ও তার মিত্র দেশ কাতার।
লিবিয়ার যুদ্ধেও প্রাণ হারিয়েছে কয়েক হাজার মানুষ, বাস্তুহারা হয়েছে কয়েক লাখ।
দুই বিবদমান পক্ষের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ এখনো চলছে এবং লিবিয়া বিষয়ে জাতিসংঘের দূত নভেম্বরের মাঝামাঝি নাগাদ জানিয়েছেন দুই পক্ষ একটা নির্বাচনের রূপরেখা নিয়ে প্রাথমিকভাবে একমত হয়েছে।
হংকং : হংকংয়ে গণতন্ত্রপন্থীদের অব্যাহত চীনবিরোধী বিক্ষোভ দমন করতে কর্তৃপক্ষ নতুন জাতীয় নিরাপত্তা আইন আনার প্রস্তাব করলে হংকংয়ে এর বিরোধিতা করে ব্যাপক প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয়, পুলিশের সাথে সংঘর্ষ চলে প্রতিবাদকারীদের। গ্রেপ্তার হয় শত শত মানুষ।
এরপর ৩০ জুন চীন দেশদ্রোহিতা, বিচ্ছিন্নতাবাদ, নাশকতা নিষিদ্ধ করে নতুন জাতীয় নিরাপত্তা আইন পাস করে। সমালোচকেরা বলছেন, হংকংয়ের সংক্ষিপ্ত সংবিধানে দেশটিকে যে স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে, এই আইন তা খর্ব করবে।
থাইল্যান্ড : জুলাই মাস থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষার্থী রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছে থাইল্যান্ডের রাজতন্ত্র আর রাজনৈতিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটানোর দাবিতে। থাইল্যান্ডের রাজার অসীম ক্ষমতা খর্ব করার দাবি জানাচ্ছে তারা। রাজার জন্য জনগণের অর্থ ব্যয়েরও সীমা বেঁধে দিতে চায় তারা। থাইল্যান্ডের আধুনিক ইতিহাসে রাজাকে এরকম প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ করার উদাহারণ আর নেই। বিক্ষোভ দমনে সরকার সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, জারি করেছে জরুরি অবস্থা। তরুণ প্রজন্ম যেভাবে রাজতন্ত্র এবং এর প্রতিনিধিত্বকারী সবকিছুকেই প্রশ্ন করতে শুরু করেছে, তাতে এটি এক দীর্ঘ অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের শুরু বলেই অনেকে মনে করছে।
বেলারুশ : বেলারুশে ৯ আগস্ট প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যানের পর বিক্ষোভ শুরু করে বিরোধীরা। ২৬ বছর একনাগাড়ে ক্ষমতায় থাকা প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কোর পদত্যাগের দাবিতে এই বিক্ষোভে যেভাবে দেশটির মানুষ অংশ নেয়, তা ছিল অভূতপূর্ব। বহু নগরী, শহর ও গ্রামে পর্যন্ত এই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। করোনার ঝুঁকি উপেক্ষা করে লাখো মানুষ পথে নামে। তারা নির্বাচনে বিরোধী প্রার্থী স্ভেতলানা তিখানোভস্কায়াকেই বিজয়ী ঘোষণার দাবি জানায়। বিক্ষোভে আটক হয় হাজার হাজার মানুষ। বেলারুশে বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশি নির্মমতার ব্যাপক অভিযোগ ওঠে। সাত ঘণ্টা আটক অবস্থায় থাকার পর মুক্তি পেয়েই তিখানোভস্কায়া পালিয়ে যান লিথুয়ানিয়ায়। নভেম্বরের শেষে লুকাশেঙ্কো প্রথমবারের মতো ইঙ্গিত দেন, তিনি ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে পারেন। তবে কবে তা তিনি বলেননি।
লেবানন : লেবাননের রাজধানী বৈরুতের বন্দর এলাকায় ভয়াবহ বিস্ফোরণের জন্য সরকারের অবহেলাকে দায়ী করে সরকারের বিচারের দাবিতে পথে নামে বৈরুতবাসী। বিস্ফোরণ পরবর্তী সরকারবিরোধী এই বিক্ষোভ ছিল নজিরবিহীন। নিহতের সংখ্যা বাড়ার পটভূমিতে গণ অসন্তোষের মুখে পদত্যাগ করেন প্রধানমন্ত্রী হাসান দিয়াব।
এরমধ্যেই দেশের রুগ্ন অর্থনীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বেকারত্ব, দুর্নীতির অবসান ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তনের দাবিতে দেশে বিক্ষোভ চলমান ছিল। ধর্মের ভিত্তিতে ক্ষমতার ভাগাভাগির ব্যবস্থারও পরিবর্তন চাইছিল দেশের মানুষ। সাধারণ মানুষের অভিযোগ, সরকারের অব্যবস্থাপনা এবং দেশের অর্থনৈতিক নীতি-নির্ধারণীর বলি হিসেবে তারা ভোগান্তি পোহাচ্ছে। জিডিপি ও বৈদেশিক ঋণের অনুপাতের হিসেবে লেবানন এই মুহূর্তে বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ ঋণগ্রস্ত দেশ।
করোনার টিকা
বছরের শুরুতে অচেনা এক জীবাণু সারা বিশ্বে যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছিল, তার দাপট চলেছে সারা বছর ধরে। সংক্রমণ ঠেকাতে সারা বছর ধরে হিমশিম খেয়েছে দেশগুলো। বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন কার্যকর টিকাই পারে এই ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে।
তবে মহামারির শুরুতে এটিও সতর্ক করা হয়েছিল যে, টিকা তৈরি করতে অনেক বছর সময় লেগে যায়, তাই খুব দ্রুত কিছু পাওয়ার আশা যেন মানুষ না করে।
কিন্তু নভেম্বরের ৯ তারিখে মার্কিন কোম্পানি ফাইজার ও জার্মানির বায়োএনটেক যৌথভাবে টিকা উদ্ভাবনে তাদের সাফল্য ঘোষণা করে জানায়, তাদের টিকার ক্লিনিকাল ট্রায়ালে প্রমাণ হয়েছে করোনার আক্রমণ থেকে লোকজনকে রক্ষা করতে তাদের টিকা ৯০ শতাংশের বেশি কার্যকর।
ছয়টি দেশে ৪৩ হাজার ৫০০ জনের শরীরে এই টিকার কার্যকারিতা পরীক্ষা করে এতে ঝুঁকিপূর্ণ কিছু দেখা যায়নি বলে তারা জানায়।
ডিসেম্বরের গোড়ায় বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে ফাইজার ও বায়োএনটেকের করোনাভাইরাস টিকার অনুমোদন দেয় ব্রিটেন এবং শুরু হয় তাদের টিকাদান কার্যক্রম।
টিকা তৈরির যেসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে এক দশকের বেশি সময় লেগে যায়, সেখানে মাত্র ১০ মাসে এই টিকা আবিষ্কারের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা চিকিৎসা বিজ্ঞানে নজিরবিহীন অর্জন।
যুক্তরাষ্ট্রও ডিসেম্বরে ফাইজার ও বায়োএনটেক এবং দ্বিতীয় আরেকটি প্রতিষ্ঠান মডার্নার ভ্যাকসিনের অনুমোদন দিয়ে সেদেশে টিকাদান কার্যক্রম শুরু করেছে।
তবে যে টিকাটির দিকে বিশ্বের অনেক দেশ তাকিয়ে আছে সেটি হলো ব্রিটেনের অক্সফোর্ড ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন। তাদের টিকাটি আরো সহজলভ্য, দামে কম এবং বিতরণ ও মজুত সহজ। এই টিকাটি খুব শিগগিরই অনুমোদিত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এ ছাড়া রাশিয়া গত আগস্ট মাসে স্থানীয়ভাবে ব্যবহারের জন্য স্পুটনিক ভি নামের তাদের টিকাকে লাইসেন্স দিয়েছে এবং এখন সেটির ব্যবহারও শুরু হয়েছে। এই টিকা ৯২ শতাংশ নিরাপদ বলে জানানো হচ্ছে। এবং তাদের ট্রায়ালের ফলাফলও অল্পদিনের মধ্যেই প্রকাশ করার কথা।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আরো অনেক প্রতিষ্ঠানই এখন করোনার টিকা তৈরির কাজ করছে এবং তাদের ট্রায়াল বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে।
মানুষ আশা করছে, সফল ও কার্যকর টিকাই একমাত্র এই ভয়াবহ রোগের আতঙ্ক কাটিয়ে উঠে মানুষকে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দিতে পারবে।