পুরোনো বছরে জঙ্গিবাদের নতুন চেহারা
পুরোনো বছরে বাংলাদেশে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা হলো জঙ্গিবাদ। পৃথিবীর বৃহত্তম এই ব-দ্বীপে নানা আঙ্গিকে জঙ্গিবাদ হানা দিলেও এত বিপুলভাবে জঙ্গিবাদ কখনো এই দেশটিতে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। তবে বিদায়ী বছরের ১ জুলাই রাজধানীর গুলশানের অভিজাত রেস্তোরাঁ হলি আর্টিজানে হামলার মধ্য দিয়ে জঙ্গিবাদ ফিরে আসে নতুন চেহারা নিয়ে।
গুলশানের সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা আক্ষরিক অর্থে পুরো দেশকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। ওই সময়ে সারা বিশ্বের নজর ছিল বাংলাদেশের দিকে। বাংলাদেশে ভয়াবহতম ওই জঙ্গি হামলার আকস্মিকতায় দেশবাসী হয়ে পড়েছিল বিমূঢ়।
বিদায়ী বছরে সবচেয়ে আলোচিত ও সাড়াজাগানো ঘটনা ছিল গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁ ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ঈদের নামাজে জঙ্গি হামলা। এ ঘটনায় দেশি-বিদেশি মানুষসহ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরাও নিহত হন।
১ জুলাই রাতে হলি আর্টিজানে হামলার পরদিন সকালে যখন সেনা অভিযানে ঘটনার পরিসমাপ্তি ঘটে, ততক্ষণে অভিজাত ওই রেস্তোরাঁয় মারা গেছেন ১৭ বিদেশিসহ ২২ বেসামরিক নাগরিক, দুই পুলিশ কর্মকর্তা। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নিহত হয় পাঁচ হামলাকারী।
হলি আর্টিজানে ওই জঙ্গি হামলার ঘটনার পর বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে সারা বিশ্বে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। এরপরই বাংলাদেশ সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শক্ত হাতে জঙ্গি দমনের উদ্যোগ নেয়। আর এ দমন অভিযানে সফলতাও আসে ব্যাপক।
গুলশানে জঙ্গি হামলার ঘটনার পরপরই নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিমকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পরে তাঁকে আদালতে পাঠানো হলে আদালত দুই দফায় রিমান্ডের আদেশ দেন। এখনো তিনি কারাগারে আটক রয়েছেন। অন্যদিকে, এ ঘটনায় তাহমিদ হাসিব খান নামের এক কানাডা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকে গ্রেপ্তার করা হলেও শেষ পর্যন্ত তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তবে তাঁকে পুলিশকে সহযোগিতা না করার অভিযোগে একটি মামলায় আসামি হতে হয়েছে। ওই মামলায় তিনি জামিন নিয়ে এখন মুক্ত আছেন।
তবে এত কিছুর পরও গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার ঘটনার মামলায় এখনো তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়নি। আগামী ২২ জানুয়ারি এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদনের দিন রাখা হয়েছে।
ওদিকে গুলশান হামলার পর পরই কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ার ঈদুল ফিতরের নামাজের সময় পুলিশের ওপর অতর্কিতে হামলা চালানো হয়। এতে আনসারুল হক ও জহিরুল ইসলাম নামের দুই পুলিশ কনস্টেবলসহ চারজন নিহত হন। এ ঘটনায় পুলিশের গুলিতে ঝর্ণা ভৌমিক নামের এক গৃহবধূ ও হামলাকারী আবির রহমানও নিহত হন। আহত হয়েছেন আরো ১২ পুলিশ সদস্য।
শোলাকিয়ায় ঈদের নামাজে হামলার ঘটনায় পুলিশ বেশ কয়েকজনকে আটক করে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করে। তবে ওই মামলায় তদন্ত প্রতিবেদনও এখনো দাখিল করা হয়নি।
পর পর ওই দুটি জঙ্গি হামলার পর বাংলাদেশের প্রশাসন জঙ্গিবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে। ওই অভিযানের প্রথম সাফল্য আসে রাজধানীর কল্যাণপুরের জাহাজবাড়িতে। ওই ঘটনায় ১১ জঙ্গি নিহত হয় এবং রিগ্যান নামের এক জঙ্গি পুলিশের হাতে ধরা পড়ে।
অভিযানের পর পুলিশ এ ঘটনায় দুটি মামলা করে। একটি সন্ত্রাসবিরোধী আইনে, অপরটি পুলিশের কর্তব্যকাজে বাধাদানের। দুটি মামলার মধ্যে পুলিশের কর্তব্যকাজে বাধাদানের মামলায় সম্প্রতি আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে পুলিশ। সে অভিযোগপত্রে জাহাজবাড়ির মালিকসহ ছয়জনকে আসামি করা হয়েছে।
ওই মামলাটি বিচারের জন্য এখন ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে পাঠানো হয়েছে। অন্যদিকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলা তদন্ত প্রতিবেদনের জন্য আগামী ১৯ জানুয়ারি দিন রাখা হয়েছে।
কল্যাণপুরের জাহাজবাড়ির অভিযানের পরে পুলিশ অভিযান চালায় নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায়। সেখানে পুলিশ অভিযানে গুলশান হামলার অন্যতম ‘মাস্টারমাইন্ড’ তামিম চৌধুরীসহ তিনজন নিহত হন। ওই ঘটনায় নারায়ণগঞ্জ সদর থানায় মামলা দায়ের করা হয়। ওই মামলাটির তদন্তও এখনো শেষ হয়নি।
নারায়ণগঞ্জের ঘটনার পর আজিমপুরে জঙ্গি আস্তানা শনাক্ত করে পুলিশ। সেখানে অভিযানের সময় কাউন্টার টেরিজমের ইউনিটের পাঁচ সদস্য ও তিন নারী জঙ্গি আহত হন। ওই অভিযান চলাকালে শারমিন (২৫) নামের এক নারীকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় দুই সহযোগীসহ আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
আজিমপুরে জঙ্গি আস্তানার ঘটনায় পুলিশ চকবাজার থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলা দায়ের করে। ওই মামলাটিও এখন তদন্তের পর্যায়ে রয়েছে।
আজিমপুরের পর পুলিশ মিরপুরের আরামবাগে জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালায়। সেখানে অভিযানে নিহত হন জঙ্গি মুরাদ ওরফে মেজর মুরাদ। আহত হন তিন পুলিশ সদস্য। মুরাদের ছুরিকাঘাতে এক পুলিশ কর্মকর্তার মেরুদণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
অভিযানের পর সন্ত্রাসবিরোধী আইন ও পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় মিরপুরের রূপনগর থানায় মামলা দায়ের করা হয়। মামলাটি এখন তদন্তাধীন রয়েছে।
এ ছাড়া টাঙ্গাইলে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) অভিযানে দুই জঙ্গি নিহত হন। ঘটনার সময় পুলিশের দুই সদস্যও আহত হন। গত ৮ অক্টোবর সকাল সাড়ে ১০টার দিকে শহরের পৌর এলাকা কাগমারার মির্জাবাড়ির মাঠের কাছে তিনতলা একটি ভবনে অভিযান চালালে জঙ্গিদের সঙ্গে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। ঘটনার পরপরই তিনতলা ওই ভবনটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ঘিরে রাখেন।
ওই ভবনের কক্ষ থেকে একটি পিস্তল, একটি রিভলবার, ১০টি চাপাতি, পাঁচটি গুলি, দুটি ল্যাপটপ ও নগদ ৬৪ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় টাঙ্গাইল সদর থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করে পুলিশ। মামলাটি এখনো তদন্তের পর্যায়ে রয়েছে।
সারা দেশে জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের এ সময়ের মধ্যে গাজীপুরের জয়দেবপুরে দুটি ‘জঙ্গি আস্তানায়’ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে দুই জঙ্গি নিহত হন। অভিযানে নব্য জেএমবির ঢাকা বিভাগীয় কমান্ডার আকাশ (২৫) ও আনুমানিক ২০ বছর বয়সী অজ্ঞাত এক যুবক নিহত হন।
পরে ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ একে-২২ বোরের একটি রাইফেল, তিনটি চাপাতি, বিপুল পরিমাণ গুলি, বোমা তৈরির সরঞ্জাম, ল্যাপটপ উদ্ধার করে।
এরপর ‘জঙ্গি আস্তানা’ সন্দেহে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নয়াগাঁও পাতারটেক এলাকায় আরেকটি বাড়ি ঘিরে রেখে অভিযান চালানো হয়। ওই ঘটনায়ও একটি মামলা দায়ের করা হয়, যা বর্তমানে তদন্তের পর্যায়ে রয়েছে।
সর্বশেষ গত ২৪ ডিসেম্বর দক্ষিণখানের আশকোনায় হজ ক্যাম্পের পাশে জঙ্গি অভিযান হয়। ওই অভিযানে এক নারী জঙ্গি ও কিশোর নিহত হন।
এ ছাড়া আত্মসমর্পণ করেন দুই নারী জঙ্গি ও দুই শিশু। ওই দিন দিবাগত রাতে আশকোনার সূর্য ভিলা ঘিরে ফেলেন কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সদস্যরা। জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান তাঁরা। কিন্তু জঙ্গিরা পাল্টা পুলিশকে প্রতিহত করার ঘোষণা দেন।
এরপর রাতভর চলে অভিযানে। শেষে আত্মঘাতী বোমায় এক নারী জঙ্গি নিহত ও পুলিশের গুলিতে আরেক কিশোর জঙ্গি নিহত হয়। ওই ঘটনায় দক্ষিণখান থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
এই মামলাটিতে আগামী ১৭ জানুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদনের জন্য তারিখ রাখা হয়েছে। এ ছাড়া ওই মামলায় তৃষ্ণা ও শিলা নামের দুই নারীকে সাত দিনের রিমান্ডে পাঠান আদালত।