ইলিশের গল্প
বহু যুগ আগেই বাঙালিরা মাছের প্রেমে পড়েন। আদিকাল থেকে সমুদ্র পথে যাতায়াত করা ভারত বাসীর মধ্যে অন্যতম হলো বাঙালিরা। সমুদ্র আর নদী দুটোই চষে ফেলে মাছ এবং অন্য সামুদ্রিক প্রাণী ধরে আনে তারা। কিন্তু বেশির ভাগ সময় ভালোবেসেছে তাজা মিষ্টি জলের মাছ।
যখন আর্যরা মধ্য এশিয়া থেকে বাংলায় আসে তখন থেকে এখানকার মৎস্যজীবীদের জীবন ধীরে ধীরে পাল্টে যায়। আস্তে আস্তে বৈদিক ধর্মানুষ্ঠানের প্রভাব পড়তে থাকে খাবার তৈরি বা জীবিকার উপর।
ব্রাহ্মণরা আগে কট্টর নিরামিষী ছিলেন। তাই মাছ খেতে পারতেন না। কিন্তু মাছের লোভ সামলাতে না পেরে বলতে লাগলেন, শাস্ত্রে বলা আছে মাছেরা আসলে সমুদ্রের ফল বা জলতরু তাই অনায়াসে মাছকে শাক-সব্জির মধ্যে ফেলা যায়। এই বলে কার্যত মাছের আমিষত্ব হরণ করতেন তারা।
মাছের মধ্যে বাঙালিদের সব থেকে প্রিয় মাছ হলো ইলিশ। রূপালি রঙের এই মাছ ক্রান্তীয় অঞ্চলে পাওয়া যায়। বড় ইলিশের ওজন আড়াই কেজি অব্দি হয়। নীল আর সবুজ আগাছা এবং অন্যান্য সামুদ্রিক গাছপালা এদের প্রধান খাবার। স্ত্রী মাছ পুরুষ মাছের থেকে তাড়াতাড়ি বাড়ে আর সাইজেও বড় হয়। ইলিশ মাছ খুব ভলো সাঁতার কাটে পারে একবারে প্রায় ৬০ কিলোমিটার সাঁতার কাটতে পারে। এক থেকে দু বছরের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে যায় এই মাছ। মূলত সমুদ্রের মাছ হলেও উপকুলীয় অঞ্চলের নদীতেও মাঝে মাঝে পাওয়া যাই ইলিশকে।
পারস্য উপসাগর, লোহিত সাগর, আরব সাগর বঙ্গোপসাগর, ভিয়েতনাম সি আর চায়না সি-তে ইলিশ পাওয়া যায়। এছাড়াও ইরান আর ইরাকের টাইগ্রিস আর ইউফ্রেটিস, পাকিস্তানের সিন্ধু নদ, মায়ানমারের ইরাবতী এবং বাংলাদেরের পদ্মা, মেঘনা, যমুনা আর কিছু উপকূলবর্তী নদীতেও ইলিশের দেখা মেলে। ভারতের বিভিন্ন নদীতে উজানে সাঁতার কেটে সমুদ্র থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ঢোকে ডিম পারতে। রূপনারায়ণ, গঙ্গা, মহানদী চিলকা লেক আর গোদাবরী নদীতে এই রূপালি মাছের ঠিকানা মেলে।
উত্তর আমেরিকার স্যামন মাছও এভাবে সমুদ্র থেকে নদীতে আসে। ডিম ফুটে জন্মানোর পর নির্দিষ্ট সময় পর ইলিশ ফের ফিরে যায় সমুদ্রে। তবে সমুদ্রের ইলিশ একদম বিস্বাদ আবার নদীর ইলিশ ঠিক তার উল্টো।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরেই বহু বিতর্ক হয়েছে কোন্ নদীর ইলিশ বেশি সুস্বাদু, গঙ্গার না পদ্মার। ঘটিরা নিঃসন্দহে বলবেন গঙ্গার আর বাঙালরা ভোট দেবেন পদ্মার ইলিশকে। সত্যিটা যাই হোক না কেনো, বাঙলিদের কাছে ইলিশ আসলে পিস দ্য রেজিসতন্স।
পশ্চিমবাংলায় প্রথাগতভাবে দুর্গাপূজো থেকে সরস্বতী পূজো অব্দি ইলিশ মাছ খাওয়া হয় না। অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি অব্দি ইলিশের স্বাদ অতো ভালো হয় না। আসলে ঐ সময় ইলিশ মাছের ব্রিডিং সিজন কিন্তু একবার যখন ইলিশের মৌসুম শুরু হয় বাঙালিদের এই মাছ খাওয়া থেকে কেউ আটকে রাখতে পারে না।
অনেক বাঙালি হিন্দু পরিবারে জোড়া ইলিশ আনা হয় সরস্বতী পূজোর দিন। যা সাধারণত বসন্তকালের শুরুতে হয়। আগেকার দিনে এই জোড়া ইলিশ আবার রান্না করার আগে বিয়ে দেয়া হতো ঘটা করে। শরৎকালে লক্ষ্মী পূজোর দিনেও ইলিশ মাছ এনে রান্না করা হয়, কিন্তু বাঙালদের বাড়িতেই বেশি এই রীতি দেখা যায়। বেশির ভাগ সময় মানা হয় বাঙালরা ইলিশ মাছের ভক্ত আর ঘটিরা চিংড়ির।
ইলিশ মাছকে নিয়ে অনেক রকমের গল্প শোনা যায়। তার মধ্যে একটা হলো ১৮৯৯ সালে স্বামী বিবেকানন্দ পদ্মার পার ধরে ভ্রমণ করছিলেন, একজন জেলে ১ টাকা দিয়ে ১৬টা সদ্য ধরা তাজা ইলিশ মাছ দিলেন। মাছ তো কেনা হলো, স্বামীজি এইবার পুঁইশাকের খোঁজে তীরে নেমে পড়লেন। ওঁর শাক ইলিশ খাওয়ার শখ হয়েছিলো। কিন্তু অনেক খুঁজেও কোথাও পুঁইশাকের হদিস পাওয়া গেলো না। অবশেষে একজন গ্রামবাসীর বাড়িতে পাওয়া গেলো পুঁইশাক, কিন্তু ঐ গ্রামবাসীর একটাই শর্ত স্বামীজি আগে ওকে ওঁর শিষ্য করবেন তবেই সে পুঁইশাক দেবে। কী আর করবেন স্বামীজী? রাজি হতেই হলো সুস্বাদু ইলিশের জন্যে।
বাঙালি হেঁসেলে ইলিশ মাছ ৫০-এরও বেশিভাবে রান্না করা যায়। মাছের মাথা থেকে ল্যাজা কিছুই বাদ যায় না। সাধারণত ইলিশ মাছের মাথা আর ল্যাজা দিয়ে চচ্চড়ি, ইলিশের ডিমের ভাজা বা অম্বল, সর্ষে ইলিশ, পাতুরি, দই মাছ, ইলিশ কাঁচা ঝোল আর ইলিশ ঝাল। এগুলো বিভিন্ন সুস্বাদু পদ, যা সাধারণত বাঙালি বাড়িতে রান্না করা হয়।
পশ্চিম বাংলায় সাধারণত রসুন বা পেঁয়াজ দিয়ে ইলিশ রান্না করা হয় না, কিন্তু বাংলাদেশে ইলিশের কোর্মা, পোলাও আর বিরিয়ানিও তৈরি করা হয় যাতে অনেক অনেক পেঁয়াজ, রসুন, আদা আর গরম মশলা পড়ে। ইলিশের মৌসুমে পান্তা ইলিশ ওখানকার প্রিয় জলখাবার, ভিজে ভাত, ইলিশ ভাজা, শুটকির আচার, ডাল, কাঁচা লঙ্কা আর পেঁয়াজ দিয়ে সকালের জলখাবার বেশ ভালোই জমে ওঠে।
ইলিশ আমাদের শরীরের জন্যেও খুব ভালো। ইলিশে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড আছে যা কোলস্টেরল আর ইন্সুলিনের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। চুল আর ত্বকেও চকচকে করে।
ইলিশ সঠিকভাবে রান্না করা আর কাঁটা বেছে খাওয়া একটা শিল্প। অসংখ্য ছোট ছোট নরম কাঁটায় ভর্তি ইলিশ। আর এই মাছ খুব নরম। তাই বেশিক্ষণ রান্না করলে মাছ ভেঙে যায়। আবার বেশিক্ষণ ধরে জলে ধুলে বা জলে ভিজিয়ে রাখলে এর বিখ্যাত গন্ধ হারিয়ে যায়। দেড় থেকে দুই কেজির ইলিশ খাওয়ার জন্যে আদর্শ কারণ এই সাইজের মাছে কাঁটাগুলো একটু বড় হয় তাই বাছতে সুবিধা হয়। সাধারণত ইলিশ মাছের গাদা আর পেটি আলাদা করে কাঁটা হয়, মাথার দিকটা গাদা এতে খুব ছোট কাঁটা থাকে আর নিচের দিকটা পেটি যাতে কাঁটা একটু বড় সাইজের হয়।
আগেই বলছি ইলিশ মাছের কাঁটা বেছে খাওয়া একটা আর্ট। আমার একজন মায়ের মাসি যাকে আমরা থুতু দিদি বলতাম (এইরকম নাম দেয়ার কারণ উনি থ থ করে কথা বলতেন তাই) উনি মুখে এক টুকরো মাছ নিয়ে নিপুণভাবে কাঁটাগুলো বের করে দিতেন অদ্ভূত দক্ষতায়। আমি সবসময় অবাক হয়ে ভাবতাম কী করে উনি এটা করেন। একদিন তাই আমি পেটির বদলে একটুকরো গাদার মাছ মুখে ফেললাম, ব্যস যা হওয়ার তাই হলো গলায় কাঁটা ফুটে সে একটা কাণ্ড। তক্ষুণি অনেকটা শুকনো ভাত গিলে কোনও মতে গলার কাঁটা থেকে রেহাই পেলাম।
শুধু বাঙালিরা নয়, বৃটিশরাও ইলিশ মাছের প্রেমে পড়েন। কিন্তু কাঁটা বেছে খাওয়া খুব শক্ত কাজ, তাই অন্য উপায় বের করলেন। ওঁরা দেখেন ইলিশ মাছকে যদি কোনও টকজাতীয় জিনিস দিয়ে ম্যারিনেট করে রাখা হয় তাহলে কাঁটা গলে যায়। তাই ইলিশ মাছ দিয়ে তেঁতুলের আচারের (Tamarind Pickled Hilsa) রেসিপি আবিষ্কার হলো। এই আচার যেকোনো জায়গায় নিয়েও যাওয়া যেতো আবার ইলিশের মৌসুম যখন শেষ হয়ে যেতো তারপরেও মাছ খাওয়া যেতো।
আরেকটা ইলিশের পদ যা কলকাতার অনেক রেস্তোরাঁ আর ক্লাবে পাওয়া যায় তা হলো স্মোকড্ হিলশা। মাছের কাঁটা বের করে এই পদ তেঁতুল আর উস্টারশায়ার সস দিয়ে সার্ভ করা হয়। এই প্রিপারেশন এতোটাই টেস্টি হয় যে, আমি এর জন্যে মরে যেতেও রাজি আছি। আমার রেস্তোরাঁ কিউপিজে আমরা কলকাতার সেরা স্মোকড্ হিলশা বানাই, আবার অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের পছন্দের খাবার হলো ইলিশ ক্রাম্ব ফ্রাই, যা কাঁচা পেঁয়াজ, টমেটো, টমটো সস আর কাসুন্দি দিয়ে সার্ভ করা হয়। আবার গ্রিলড ইলিশ টার্টার সস দিয়ে খাওয়া হয়। কিন্তু আমরা যদি এখনি সচেতন না হই কিছু বছরের মধ্যে কিন্তু ইলিশের প্রজাতিটাই উধাও হয়ে যাবে। এই বছর এক কেজি মাছের দাম ৯০০ থেকে ১৭০০ টাকার মধ্যে ঘোরাফেরা করেছে, যা নিঃসন্দেহে খুবই ব্যয়বহুল।
ইলিশের মৌসুম ছাড়াও সারাবছর ধরেই ইলিশ ধরার ফলে হঠাৎ করে ইলিশের উৎপাদন খুব কমে গেছে তার উপর জেলেরা আজকাল হামেশাই খোকা ইলিশ ধরছে। ফলে ইলিশ মাছ বাড়তে পারছে না, কমে যাচ্ছে ইলিশের জন্মও। ভারতে ২০০১ সালে ইলিশের উৎপাদন হয় সারাবছরে ৮০,০০০ টন আর ২০১২-তে তা কমে গিয়ে মাত্র ১২,০০০ টন এ দাঁড়িয়েছে। এছাড়াও দূষণ, মাছেদের থাকার জায়গায় দ্রুত অবনতি এই সব কারণেও জন্যেও ইলিশ মাছের উৎপাদন খুব কমে গেছে।
৯০-এর দশকে বাংলাদেশে ইলিশের উৎপাদন অনেকটাই কমে গেছিলো, কিন্তু এখন ওখানে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। যেমন : প্রজননের সময় মাছ না ধরা, অনেক জায়গায় ইলিশের স্যাংচুয়ারি তৈরি করার ফলে এখন অনেকটাই সমস্যার সমাধান হয়েছে।
পশ্চিমবাংলা সরকার সম্প্রতি একটা বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে তাতে ইলিশ মাছ ধরার উপর বিভিন্ন বিধিনিষেধ আনা হয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশের মতো পাঁচটা সংরক্ষিত হিলশা স্যাংচুয়ারি চিহ্নিত করা হয়েছে।
আশা করি, যদি ভবিষ্যতে এই নিয়ম এবং বিধিনিষেধ সত্যি কঠোরভাবে পালন করা হয়, তাহলে একদিন বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাবে না আমাদের এই প্রিয় ইলিশ মাছ।