ঢাকার কথা ৭
মোগল ঢাকার ১০০ বছর
ভারতে মোগল অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় ১৫২৬ সালে। ১৬১০ সালে সারা বাংলায় মোগল অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ঢাকা দখলের মধ্যদিয়ে মোগলদের বাংলা অধিকার সম্পন্ন হয়েছিল। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের মধ্যদিয়ে প্রকৃত অর্থে ভারতে মোগল শাসনের অবসান ঘটে। ১৫৭৬ সালে আফগান শাসনের অবসান ঘটিয়ে সম্রাট পশ্চিম ও উত্তর বাংলার অনেকটাই অধিকার করেছিলেন। পূর্ব বাংলার জয় বাকী রেখেই তখন বাংলা মোগল প্রদেশ বা সুবা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। পূর্ববাংলা অধিকারের কারণে ইসলাম খান চিশতিই ১৬১০ সালে প্রথম পূর্ণাঙ্গ সুবা বাংলার সুবাদার হয়েছিলেন। ঢাকা এ সময় সুবা বাংলার রাজধানী হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই ঢাকার সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে একটি বিকাশমান ধারা লক্ষ করা গিয়েছিল। গোটা মোগল শাসনপর্বে এই ধারা অব্যাহত থাকলে ঢাকার নাগরিক জীবনে অগ্রগতি নিশ্চিত হতো। কিন্তু তেমনটি ঘটল না। বাংলার অধিকাংশ সুবাদারই ঢাকাকে আপন করে নিতে পারেননি। দিল্লি থেকে দূরবর্তী অঞ্চল বলে এবং এখানকার আবহাওয়ার সাথে খাপখাওয়াতে না পেরে সবাই বদলি হয়ে দিল্লি ফিরে যেতে চেষ্টা করেছেন। একমাত্র মীরজুমলা ও শায়েস্তা খান ছাড়া কেউ ঢাকার উন্নয়নের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন তেমন প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যায় না।
মোগল সুবার যুগে ঢাকার নাগরিক জীবনের গুরুত্ব অব্যাহত থাকে ১৬১০ থেকে পরবর্তী প্রায় ১০০ বছর। রাজধানী কেন্দ্রের অবস্থান ছাড়াও এ সময় মোগল সুবাদার ও অন্যান্য কর্মচারীদের আবাস স্থলগুলো গড়ে উঠতে থাকে ঢাকায়। তবে ১০০ বছরের খতিয়ানেও ঢাকার রাজধানীর মর্যাদা অব্যাহত ছিল না। ১৬৩৯ থেকে ১৬৫৯ এই ২০০ বছরের একটি ছন্দপতন ছিল। সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহজাদা সুজা সুবাদারের দায়িত্ব পালনের জন্য ১৬৩৯ সালে বাংলায় এসেছিলেন। ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক কৌশলগত কারণে তিনি কিছু সময় ঢাকায় অবস্থান করলেও পরে পাকাপাকিভাবে রাজমহলে অবস্থান করেন। এ জন্য সুজার সুবাদারির সময়কাল ঢাকা কাগজপত্রে রাজধানী থাকলেও প্রশাসন পরিচালিত হতো রাজমহল থেকে। ফলে ঢাকার গুরুত্ব এ সময় কিছুটা হ্রাস পায়। এ পর্যায়ে ঢাকা কার্যত ছিল একটি স্থানীয় প্রশাসন কেন্দ্র।
সুজার বাংলায় অবস্থানকালীন সময়ে শাহজাহানের পুত্রদের মধ্যে উত্তরাধীকার যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। আওরঙ্গজেবের ভয়ে শাহসুজা আরাকানে পালিয়ে যান।
এরমধ্যে দিল্লির সিংহাসনে পালাবদল ঘটে। সম্রাট হন আওরঙ্গজেব। তিনি মীরজুমলাকে দ্বিতীয়বারের জন্য বাংলার সুবাদার নিয়োগ করেন। মীরজুমলা ঢাকায় অবস্থান করায় ঢাকা আবার প্রধান প্রশাসনিক কেন্দ্রে পরিণত হয়। আঠার শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত ঢাকার রাজধানীর মর্যাদা অক্ষুণ্ন থাকে।
মীর জুমলা ঢাকায় প্রেরিত সুবাদারদের মধ্যে প্রশাসক ও সমরনেতা হিসেবে সবচেয়ে দক্ষ ছিলেন। তিনি ঢাকায় সুবাদারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন ১৬৬০ সালে। মাত্র তিন বছর দায়িত্ব পালনের মধ্যদিয়েই তিনি তাঁর যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে পেরেছিলেন।
রক্ত সম্পর্ক, বৈবাহিক সম্পর্ক এবং প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক কারণে ইরানের সাথে মোগল সম্রাটদের অনেকেরই ঘনিষ্ট যোগাযোগ ছিল। মীর জুমলাও ছিলেন ইরানি। ১৫৯১ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইস্পাহানের আর্দিস্তান শহরে জন্ম গ্রহণ করেন। যৌবনে তিনি এক ব্যবসায়ীর অধীনে চাকরি নিয়ে দক্ষিণ ভারতে এসেছিলেন। সম্রাট শাহজাহানের শাসনকালে শাহজাদা আওরঙ্গজেব যখন দাক্ষিণাত্যের শাসক তখই মীর জুমলা শাহজাদার নজরে আসেন। আওরঙ্গজেব সম্রাট হওয়ার পর বিদ্রোহী ভাইদের দমন করার জন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এ সময় বাংলার সুবাদার ছিলেন শাহ সুজা। শাহ সুজাকে দমন করার জন্য আওরঙ্গজেব মীর জুমলার নেতৃত্বে সৈন্য পাঠান। শাহ সুজা প্রথম খাজোয়াতে মীর জুমলার মুখোমুখি হন। মীর জুমলার সাথে এঁটে উঠতে না পেরে সেখান থেকে পালিয়ে আসেন শাহ সুজা। কিন্তু শাহ সুজা পালালেও তার পিছু ছাড়েননি মীর জুমলা। তাই সুজা তখন পালিয়ে আসেন ঢাকায়। মীর জুমলাও ঢাকার দিকে অগ্রসর হন। ফলে বাধ্য হয়ে সুজা আরাকানে পালিয়ে যান। মীর জুমলা ঢাকায় আসার অল্পদিন পরই আওরঙ্গজেব তাঁকে বাংলার সুবাদার হিসেবে নিয়োগ দেন।
সুবাদারের দায়িত্ব গ্রহণের পরে মীর জুমলা আবার রাজধানী রাজমহল থেকে ফিরিয়ে আনেন ঢাকায়। এবার তিনি ঢাকা পুনর্গঠনের দিকে মনোযোগ দেন। প্রথমেই তাঁর চোখে পড়ে ঢাকার অবনতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। তাই প্রথমেই তিনি আইন বিভাগকে সংস্কার করার চিন্তা করেন। মীর জুমলা তদন্ত করে অসৎ কাজী ও আইন বিভাগের কর্মকর্তাদের চাকরিচ্যুত করেন। নিয়োগ দেন সৎ কর্র্মকর্তাদের। ঢাকায় নির্মাতা সুবাদারদের মধ্যে শায়েস্তা খানের পর মীর জুমলার নামই অগ্রগণ্য। সৈন্যবাহিনী ও রসদ দ্রুত স্থানান্তরের সুবিধার জন্য তিনি ঢাকার রাস্তাঘাটের উন্নয়নের চিন্তা করেন। এই লক্ষ্যে তিনি দুটি রাস্তা ও দুটি সেতু নির্মাণ করেছিলেন। ঢাকার সুরক্ষার জন্য মীর জুমলা মুন্সীগঞ্জ থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত তিনটি জলদুর্গ নির্মাণ করেন। এ ছাড়া তিনি টঙ্গীতে একটি দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। বর্তমানে অবশ্য এর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। ঢাকার সাথে উত্তরাঞ্চলের সড়কটির নিরাপত্তা বিধানের জন্যই এই দুর্গ নির্মাণ করা হয়েছিল। মীর জুমলা ঢাকার জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় শহরকে আরো বিস্তৃত করার চিন্তা করেন। এই লক্ষ্যে তিনি ঢাকার পূর্ব-দক্ষিণে ধাপা অর্থাৎ বর্তমান ফতুল্লা পর্যন্ত নগর বিস্তারের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। লক্ষ্য অর্জনের জন্য সুবাদার ঢাকা থেকে ধাপা পর্যন্ত একটি সড়ক নির্মাণ করেন। ফতুল্লার কাছাকাছি পাগলা সেতুটিও নির্মাণ করান মীর জুমলা।
বাংলার বাণিজ্য মীর জুমলা অনেক বেশি গতিশীল করেছিলেন। ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষায় সুবাদার অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এ সময় সুবাদারের আনুকূল্য লাভ করেন ওলন্দাজ ও ইংরেজ বণিকরা।
ঢাকায় অবস্থানকালেই মীর জুমলা আসাম জয়ের জন্য অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। অবশ্য এর কারণও ছিল। এর আগেই আসামের রাজা জয়ধ্বজ সিংহ কামরূপ দখল করে নিয়েছিলেন। এটি ছিল বাংলা সুবার অন্তর্গত। একই সময় বাংলার সামন্ত রাজ্য কুচবিহারের রাজা প্রাণনারায়ণ আনুগত্য অস্বীকার করেন। তাই মীর জুমলার ওপর দুটো দায়িত্ব ছিল। আসাম জয় ও কুচবিহারের রাজাকে শাস্তি দেওয়া। তিনি স্থল ও নৌবাহিনী কামরূপের দিকে প্রেরণ করে নিজে কুচবিহারের দিকে অগ্রসর হন। মীর জুমলা অনায়াসেই কুচবিহার দখল করে নেন। এবার তিনি কামরূপের দিকে অগ্রসরমান দলের সাথে যোগ দেন। এই সংবাদ পেয়ে কামরূপের রাজা পালিয়ে যান। কামরূপ জয়ের পর ফিরে না এসে মীর জুমলা আসাম জয়ের জন্য অগ্রসর হন। কিন্তু আসামের পার্বত্য অঞ্চলে মোগল বাহিনী অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। বৃষ্টি, বন্যা ও পাহাড়িদের আক্রমণে মোগল বাহিনী দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মহামারি দেখা দেয়। মীর জুমলা নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত আসামের রাজার সাথে সন্ধি করে ঢাকার পথে অগ্রসর হন মীর জুমলা। অবশেষে অসুস্থ মীর জুমলা ঢাকার কাছে খিজিরপুরে ১৬৬৩ খ্রিস্টাব্দের ৩০ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন।
মীরজুমলার আকস্মিক মৃত্যুর কারণে পরপর দুজনকে স্বল্পকালের জন্য সুবাদারের দায়িত্ব দিয়ে বাংলায় পাঠানো হয়েছিল। এঁরা হচ্ছেন দিলীর খান ও দাউদ খান। সম্রাট আওরঙ্গজেব বুঝতে পারলেন বাংলার সুবাদারের দায়িত্ব পালনের জন্য দক্ষ ও বীচক্ষণ একজন ব্যক্তির প্রয়োজন। এবার তিনি যোগ্যতার বিচারে শায়েস্তা খানকে নির্বাচন করলেন। সম্পর্কে শায়েস্তা খান সম্রাটের মামা। তিনি ছিলেন উচ্চশিক্ষিত। সম্রাট বিশেষ সম্মানের সাথে শায়েস্তা খানকে বাংলায় পাঠালেন। এ সময় শায়েস্তা খানকে পাঁচ হাজারী মনসব দেওয়া হয় এবং আরো দেওয়া হয় আমীরুল ওমরাহ উপাধি।
শায়েস্তা খানের সময়েই ঢাকার গৌরব অনেক বৃদ্ধি পেয়েছিল। তিনি ১৬৮৮ সাল পর্যন্ত সুবাদারের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তী সুবাদারদের কৃতিত্ব তেমন উল্লেখযোগ্য ছিল না। ঢাকার ১০০ বছরের সুবাদারির শেষ সুবাদার ছিলেন শাহজাদা আজিমুদ্দিন। এ সময় দিওয়ানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল মুর্শিদকুলি খানকে। একপর্যায়ে আজিমুদ্দিন ও মুর্শিদকুলি খানের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় বিপন্ন হয় ঢাকার ভাগ্য। সুবাদারীর প্রশাসনিক কেন্দ্র ঢাকা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় পাটনাতে। আর দিওয়ানীর কেন্দ্র চলে যায় মুর্শিদাবাদে। তবে মুর্শিদকুলি খান ১৭১৫-১৬ খ্রিস্টাব্দে সুবাদার বা নাজিম পদে নিয়োগ পেয়ে রাজধানী পুরোপুরি মুর্শিদাবাদে স্থানান্তর করার পূর্ব পর্যন্ত সুবাদারের প্রতিনিধিরা ঢাকায় বসে শাসন পরিচালনা করতেন। এরপর থেকে ঢাকা দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কেন্দ্রের মর্যাদা পায়। একজন নায়েব নাজিম পদাধিকারী কর্মকর্তা ঢাকায় বসে শাসন কার্য পরিচালনা করেন।