ঢাকার কথা ৮
মোগল জলদুর্গ
ঢাকায় মোগল সুবার রাজধানী হওয়ার পর থেকেই একটি বড় সংকট সুবাদারদের চিন্তায় ফেলে দেয়। ক্রমাগত জলদস্যুদের আক্রমণ আতঙ্কিত করে তুলেছিল নগরবাসীকে। পর্তুগিজ ও মগ জলদস্যুরা সমুদ্র তীরাঞ্চল থেকে ছিপ নৌকা নিয়ে মেঘনার বুক চিরে এগিয়ে আসত। ধলেশ্বরীর মোহনায় এসে ডানে ঘুরে ঢুকে পড়তো শীতলক্ষ্যায়। সুলতানি যুগে এরা লুঠতরাজ করত সোনারগাঁওয়ে। ঢাকায় মোগল রাজধানী স্থাপনের পর সোনারগাঁওয়ের আকর্ষণ কমে যায়। এবার ঢাকার দিকে দৃষ্টি ফেরায় জলদস্যুরা। তারা ঢাকায় প্রবেশের নদী পথও পেয়ে যায়। শীতলক্ষ্যা দিয়ে উত্তরে অগ্রসর হয়ে বর্তমান সময়ের ডেমরার কাছে চলে আসে। বালু নদীর শাখা দোলাই নদী এই স্থান দিয়েই পশ্চিম দিকে বয়ে গেছে। দোলাই নদী ঢাকার বুক চিরে পতিত হয়েছে বুড়িগঙ্গায়। জলদস্যুরা দোলাই নদী দিয়ে অগ্রসর হয়ে ঢাকায় আক্রমণ ও লুঠতরাজ করত।
সুবাদাররা শুরু থেকেই জলদস্যুদের আক্রমণ প্রতিরোধের উপায় নিয়ে ভাবছিলেন। শেষ পর্যন্ত সুবাদার মীর জুমলা একটি পরিকল্পনা নিয়ে প্রকৌশলীদের সাথে পরামর্শ করেন। সিদ্ধান্ত হলো ঢাকাকে জলদস্যুদের হাত থেকে মুক্ত রাখতে তিনধাপে প্রতিরক্ষা দুর্গ তৈরি করতে। নদীর তীরে গড়ে তোলা এই প্রতিরক্ষা দুর্গ জলদুর্গ নামে পরিচিত হয়। সিদ্ধান্ত হয় প্রথম দুর্গটি নির্মিত হবে বর্তমান মুন্সীগঞ্জ শহরের কাছে ইছামতি নদীর তীরে ইদ্রাকপুর অঞ্চলে। ধলেশ্বরীর জল ছুঁয়ে ইছামতি বয়ে গেছে ইদ্রাকপুরের পাশ দিয়ে। দুর্গের পূর্ব দেয়ালের পাশে উঁচু স্তম্ভ বা ড্রাম তৈরি করা হবে। তার ওপর ধলেশ্বরীর দিকে মুখ করে বসানো হবে কামান। চেষ্টা করা হবে শীতলক্ষ্যায় প্রবেশের আগেই জলদস্যুদের নৌকা যেন কামানের গোলায় ভীত হয়ে ফিরে যায়।
কিন্তু এই এক স্তর নিরাপত্তায় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এবার দ্বিতীয় নিরাপত্তা দুর্গ তৈরি করার সিদ্ধান্ত হয় মোহনা থেকে প্রায় চার কিলোমিটার উত্তরে শীতলক্ষ্যার পূর্ব তীরে সোনাকান্দায়। এখানে কামান স্তম্ভ তৈরি করা হবে পশ্চিম দেয়ালের দিকে। জলদস্যুদের নৌকা শীতলক্ষ্যায় প্রবেশ করে কামানের সীমানায় এলে আঘাত হানা হবে। চূড়ান্ত নিরাপত্তার কথা ভেবে তৃতীয় নিরাপত্তা দুর্গ নির্মিত হবে আরো পাঁচ-ছয় কিলোমিটার উত্তরে শীতলক্ষ্যার পশ্চিম তীরে। বর্তমান নারায়ণগঞ্জ শহরের হাজীগঞ্জে। এভাবেই তিনটি জলদুর্গ তৈরির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন সুবাদার মীর জুমলা।
ইদ্রাকপুর দুর্গ
মুন্সীগঞ্জ শহরের কাছে এখনো ইদ্রাকপুর দুর্গটি দাঁড়িয়ে আছে। ইছামতি নদীটি এখন শুকিয়ে গেছে। তবে একটি খালের অস্তিত্ব আছে। খালটি মুন্সীগঞ্জ শহরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এই দুর্গের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে। দুর্গের অবস্থান এখন নিশ্চিত করতে হলে বলতে হবে দেওভোগ গ্রামের পূর্ব প্রান্তে ও অফিসার পাড়ার দক্ষিণে এই দুর্গটি অবস্থিত। মীর জুমলা কর্তৃক ইদ্রাকপুর দুর্গটি নির্মিত হয় ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে।
দুর্গ এলাকাটি চতুর্ভজ আকৃতির। মোগল দুর্গের প্রচলিত আদলে দেয়াল বেষ্টিত এবং দেয়ালের উপরিভাগে মার্লন শোভিত। ভেতরে প্রবেশ করার জন্য উত্তরমুখী তোরণ রয়েছে। ভেতরে রয়েছে প্রশস্ত খোলা চত্বর। বেষ্টন দেয়ালের চার কোণে চারটি কর্নার টাওয়ার বা বুরুজ রয়েছে। বুরুজের গায়ে ফোকর রাখা হয়েছে যেখানে বন্দুকের নল বসিয়ে গুলি ছোড়া যায়। কামান বসানোর স্তম্ভ বা ড্রামটি বেশ প্রশস্ত ও গোলাকার। খোলা চত্বর থেকে স্তম্ভে পৌঁছার জন্য একটি পথ রয়েছে। কামান-স্তম্ভের দক্ষিণ পাশ ঘেঁষে ছোট সিঁড়ি পথ নেমে গেছে নিচে। সাধারণ মানুষ বলে থাকে সুরঙ্গ পথ। আসলে এটি গোপন কুঠুরি। গোলা বারুদ অস্ত্রশস্ত্র মজুদ রাখা হতো এখানে।
ইংরেজ শাসনকাল থেকেই এই দুর্গের স্থাপত্যের ওপর প্রশাসনিক আঘাত এসেছে। এক সময় কামান স্তম্ভের ওপর মহকুমা প্রশাসকের বাংলো বানানো হয়। পরে মুন্সীগঞ্জ জেলা হলে জেলা প্রশাসকের বাসস্থানও হয় এখানে। মোগল স্থাপত্যকে বিকৃতকারী এসব ইমারতের অংশ এখনো রয়েছে। এখন অবশ্য সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর দুর্গ সংস্কারের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে।
সোনাকান্দা দুর্গ
নারায়ণগঞ্জ শহরের বিপরীতে শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত বন্দর সুলতানি যুগ থেকেই গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। চৌদ্দ শতকে স্বাধীন সুলতানদের অন্যতম রাজধানী যখন সোনারগাঁও তখন সোনারগাঁওয়ের বিখ্যাত নৌবন্দরটি ছিল এই বন্দরে। সেই থেকে এলাকাটির নাম হয়ে যায় বন্দর।
সোনাকান্দা দুর্গ নামে পরিচিত এই দুর্গের অবস্থান বন্দর উপজেলায়। বন্দর ফেরিঘাট থেকে দুই কিলোমিটার দক্ষিণে সোনাকান্দা অঞ্চলে এই দুর্গের অবস্থান। আদিতে এর অবস্থান ছিল শীতলক্ষ্যা ও ব্রহ্মপুত্রের প্রাচীন সঙ্গম স্থলের কাছাকাছি। বর্তমানে শীতলক্ষ্যা নদী পশ্চিমে সরে যাওয়ায় এবং ব্রহ্মপুত্র নদের ধারা মরে যাওয়ায় লোকালয়ের আড়ালে পড়ে গেছে দুর্গটি। বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাসের তথ্য প্রকাশের আগে অনেক ক্ষেত্রেই প্রত্ন-ইমারতকে কেন্দ্র করে নানা কাহিনীর জন্ম হয়। সোনাকান্দা দুর্গ নিয়েও কাহিনী রয়েছে। জনশ্রুতি মতে, বারোভুঁইয়াদের নেতা ঈশাখাঁ বিক্রমপুরের জমিদার কেদার রায়ের বিধবা কন্যা সোনাবিবিকে বলপূর্বক বিয়ে করে এনে এই দুর্গে অন্তরীণ করেন। সোনাবিবি দুর্গে বসে কেঁদেছিলেন বলে এই দুর্গের নাম হয় সোনাকান্দা। অন্য কাহিনীতে বলা হয় ঈশাখাঁর অনুপস্থিতিতে সোনাবিবি একাকী যুদ্ধ করে মোগলদের হাত থেকে এই দুর্গ রক্ষা করতে না পেরে কেঁদেছিলেন। আর তাই এই দুর্গের নাম হয় সোনাকান্দা।
এসব জনশ্রুতির কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। এটি প্রাসাদ দুর্গ নয়- জলদুর্গ। তাই এখানে কথিত সোনাবিবিকে আটকে রাখার মতো কোনো প্রাসাদও নেই। এই দুর্গ নির্মাণ সম্পর্কিত শিলালিপি না পাওয়া যাওয়ায় এতসব কাহিনীর জন্ম হয়েছে। তবে নির্মাণশৈলী পর্যবেক্ষণ করে এবং ইতিহাসের প্রাসঙ্গিক তথ্যসূত্র পরীক্ষা করে অনেকটাই নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, এই দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন সুবাদার মীর জুমলা। অর্থাৎ সতের শতকের মধ্যভাগে দুর্গটি নির্মিত হয়েছিল।
ইটের তৈরি সোনাকান্দা দুর্গটি আয়তাকার। এর পরিমাপ ৫৮ বাই ৮৬.৫৬ মিটার। দুর্গের প্রবেশ তোরণটি উত্তর দিকে। এ ছাড়া দুর্গের চারকোণে চারটি অষ্টভুজাকার বুরুজ রয়েছে। প্রবেশ তোরণটি সাড়ে পাঁচ মিটরি চওড়া। খিলান সমৃদ্ধ মোগল স্থাপত্য রীতিতে তৈরি। আয়তকার দুর্গ দেয়াল প্রায় দেড় মিটার পুরু। শুরুতে দেয়ালের উচ্চতা ছিল সাড়ে তিন মিটার। এখন মাটি জমে এর উচ্চতা কমে গেছে। সোনাকান্দা দুর্গটি আকারে ইদ্রাকপুর ও হাজীগঞ্জ দুর্গের চেয়ে বড়। দুর্গের পশ্চিম দেয়ালের কাছাকাছি রয়েছে সিঁড়িযুক্ত খিলান পথসহ উঁচু বেদী। যেখানে পশ্চিমে নদীর দিকে মুখ করে কামান বসানো হতো।
সোনাকান্দা দুর্গটি সরকারি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সংরক্ষিত প্রত্নস্থলের অন্তর্ভুক্ত হয় ১৯৫০ সালে। এরপর দুর্গটির সংস্কার করা হয়। মোগল ত্রয়ী জলদুর্গের মধ্যে সোনাকান্দা দুর্গের বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এই দুর্গ দুটো অংশে বিভক্ত। একটি হলো কোণের বুরুজ বিশিষ্ট আয়তকার ফোকর যুক্ত অংশ আর অপরটি পশ্চিমদিকে সিঁড়িপথসহ খিলানযুক্ত উঁচু বেদী। অন্যকোনো দুর্গে এমন খিলানসহ প্রবেশপথ নেই।
সোনাকান্দা দুর্গের প্রতিরক্ষা প্রাচীর, প্রাচীরের চূড়ায় মার্লন নকশা, বুরুজ এবং উঁচু প্রাচীরে বন্দুক থেকে গুলি ছোড়া ও কামানের গোলা ছোড়ার জন্য নির্মিত ফোকর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করছে। এসব ফোকরে একটি সামঞ্জস্য রয়েছে। যেমনটি ইদ্রাকপুর ও হাজিগঞ্জের দুর্গে দেখা যাবে না। বোঝা যায় দ্বিতীয় প্রতিরক্ষা বুহ্য হিসেবে মোগল প্রকৌশলীরা সোনাকান্দা দুর্গ নির্মাণে বিশেষ মনোযোগ দিয়েছিলেন।
হাজীগঞ্জ দুর্গ
মোগল ত্রয়ী জলদুর্গের শেষটি হাজীগঞ্জ দুর্গ। তিন স্তর বিশিষ্ট নিরাপত্তার এটি ছিল শেষ ধাপ। হাজীগঞ্জ দুর্গের প্রতিরক্ষা বেষ্টনি এড়াতে পারলে সম্ভব ছিল দোলাই নদী দিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করা। হাজীগঞ্জ দুর্গের অবস্থান নারায়ণগঞ্জ শহরের উত্তর-পূর্ব দিকে শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম তীরে। এলাকাটির নামও হাজীগঞ্জ। মোগল পূর্ব যুগে এ অঞ্চলে আরেকটি দুর্গ ছিল বলে জানা যায়। যা খিজিরপুর দুর্গ নামে পরিচিত। অনেক গবেষক মত প্রকাশ করেছেন— খিজিরপুর দুর্গের ওপরই হাজীগঞ্জ দুর্গ নির্মিত হয়েছিল। তবে প্রত্নতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে এবং ভৌগোলিক কৌশলগত দিক বিচারে এই মত নির্বিচারে গ্রহণ করা যায় না। নির্মাণযুগে হাজীগঞ্জ দুর্গটি শীতলক্ষ্যার কোল ঘেঁষে ছিল। এখন নদী বেশ কিছুটা পূর্বদিকে সরে গেছে।
অন্য দুই দুর্গের মতো এখানেও শিলালিপি নেই। তাই নির্মাণকাল সুনির্দিষ্ট করা যায় না। ইদ্রাকপুর ও সোনাকান্দা দুর্গের মতো অনেকটা অভিন্ন মোগল দুর্গের আদল থাকায় এই দুর্গও সুবাদার মীর জুমলার সময়ে নির্মিত বলেই মনে করা হয়। দুর্গটি অসমবাহু বিশিষ্ট। বর্তমানে টিকে থাকা অংশটি পঞ্চভুজাকৃতি মনে হবে। তবে নির্মাণ কালে দুর্গটি ছিল ষড়ভুজাকৃতির। হাজীগঞ্জ দুর্গের উত্তর দিকে রয়েছে বিশাল প্রবেশ তোরণ। তোরণের ভেতর ও বাইরের দিকে ক্রম উচ্চতা বিশিষ্ট সিঁড়ি পথ রয়েছে। বাইরের দিকে সিঁড়ির ধাপ রয়েছে ১৮টি এবং ভেতরের দিকে ৮টি। তোরণটি স্থাপন করা হয়েছে একটি আয়তকার কাঠামোর ওপর। তোরণের চূড়ায় চমৎকার খিলান রয়েছে।
দুর্গটির দক্ষিণ বাহুর দিকে একটি বৃত্তাকার বুরুজ রয়েছে। এই বুরুজের সামনে স্থায়ীভাবে সাতটি ধাপ বিশিষ্ট উঁচু বেদী রয়েছে— বেদীর ওপর নদীর দিকে মুখ করে কামান বসানো থাকত। দুর্গের উত্তর বাহুতে আয়তকার ১.৫ মিটার দীর্ঘ ফাঁকা অংশ আছে এই ফাঁকা জায়গাটি লোহার জালি দিয়ে বন্ধ করা হয়েছে। দুর্গের গঠনের সাথে এমন নির্মাণ সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাই মনে করা হয় এই অংশটি পরে সংযোজন করা হয়েছে। দুর্গে বর্তমানে পাঁচটি বৃত্তাকার বুরুজ রয়েছে। প্রান্ত বুরুজগুলো অনেক বেশি উঁচু ছিল। এর ওপরে একটি করে কামান বসানো হতো।
হাজীগঞ্জ দুর্গের বেষ্টনী প্রচীর ও প্রতিরক্ষা বুরুজে অনেক মার্লন নকশাযুক্ত ফোকর ছিল। এখানে বন্দুক রেখে গুলি ছোড়া হতো।
দুর্গের পূর্ব কোণে একটি বেশ উঁচু বর্গাকার বুরুজ রয়েছে। বুরুজের ইটগুলো অপেক্ষাকৃত কম পুরাতন। ধারণা করা হয় পরবর্তী কোনো এক সময় এটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এই দুর্গ বহুবার সংস্কার করা হয়েছে। ১৮৯৬ সালে প্রকাশিত ‘লিস্ট অব অ্যানসিয়েন্ট মনুমেন্টস ইন বেঙ্গল’ গ্রন্থ পাঠে জানা যায়, এ সময় ধ্বংসপ্রায় অবস্থায় ছিল। এ সময় বেষ্টনী প্রাচীর ও মাত্র একটি বুরুজ থাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯৫০ সালে দুর্গটিকে প্রত্নতত্ত্ব ও জাদুঘর অধিদপ্তরের আওতায় নিয়ে আসা হয়। এরপর বিভিন্ন পর্যায়ে সংস্কার করা হয়েছে।