ঢাকার কথা ৯
চকবাজারের ইতিবৃত্ত
ঢাকার নাগরিক জীবনের এক সময়ে চকবাজারের যাত্রা শুরু। অনুমান করা হয় মোগল যুগের আগেই চকবাজার একটি নৌবন্দর ছিল। মোগলযুগ-পূর্ব থেকেই ‘চকদার’ উপাধিধারী পেশাজীবীদের কথা জানা যায়। গঞ্জের খাজনা বা শুল্ক আদায়কারী চৌকির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা ইজারাদারকে ‘চকদার’ বলা হতো। বাজার হিসেবে আত্মপ্রকাশের আগে একসময় চকবাজার এলাকাটি ‘চকবন্দর’ নামে পরিচিত ছিল। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নদীপথে পণ্য সামগ্রী এই বন্দরে এসে নামত। চকবাজারের দক্ষিণ অংশ ঘেঁষে বয়ে গেছে বুড়িগঙ্গা নদী। এই নদীই ছিল পণ্য পরিবহনের প্রধান মাধ্যম। পূর্বাঞ্চলে ব্রহ্মপুত্র, বালু ও শীতলক্ষ্যা নদী দিয়ে পণ্য বোঝাই নৌকা দোলাই নদী হয়ে ঢাকার বুক চিরে বুড়িগঙ্গায় পড়ত। এরপর বুড়িগঙ্গা দিয়ে আনুমনিক দুই কিলোমিটার এসে চকবাজারে ভিড়ত।
চকবাজার প্রতিষ্ঠা সম্ভবত মোগল যুগেই হয়েছিল। নবাব শায়েস্তা খান ১৬৭৬ সালে চকবাজারের পশ্চিম পাশে একটি সুদৃশ্য মসজিদ স্থাপন করেন। এই মসজিদ নির্মাণের মধ্য দিয়েই চকবাজারের যাত্রা শুরু হয়। প্রথমদিকে চকবাজারটি খুব পরিকল্পিত ছিল না। এলোমেলো দোকানপাটের পসরা বসত। এই বাজারকে একটি পরিকল্পনার আওতায় নিয়ে আসেন নবাব মুর্শিদকুলি খান। চকবাজারের আশপাশের রাস্তাগুলো প্রশস্ত করে এর গুরুত্ব বাড়ানো হয় ইংরেজ শাসন আমলে। ১৮২৫ সালে ঢাকায় মেজিস্ট্রেট ওয়াল্টার রাস্তাগুলো প্রশস্ত করায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।
উনিশ শতকের চকবাজার সম্পর্কে একটি বর্ণনা পাওয়া যায় ‘এন্টিকুইটিজ অব ঢাকা’ নামের একটি মূল্যবান গ্রন্থে। গ্রন্থের ভাষ্যে চকবাজার ছিল ঢাকার সবচেয়ে পুরনো বিপণিকেন্দ্র। বাজার এলাকার প্রাচীন নাম ছিল ‘নেকাউস’। কেউ কেউ ‘নাখাস’ও উচ্চারণ করেন। বাজার এলাকাটি ছিল চতুষ্কোণ। আনুমানিক আয়তন হবে ২০০ গজ। বাজারে যেসব পণ্যের দোকান বসত তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে শাকসবজি, নানারকম ফল, ছোটদের খেলনা, মিষ্টান্ন ও মনোহারী পণ্য।
পশু ও ক্রীতদাস ক্রয়বিক্রয়ের সাথে আরবি ‘নাখাস’ শব্দের সম্পর্ক রয়েছে। এই কারণেই মনে করা হয় চকবাজার এলাকায় হয়তো একসময় পশুর হাট বসত। বাংলাদেশে সুলতানি আমলেও গৃহকর্মের জন্য দাসদাসী বেচাকেনা হতো বলে ইতিহাসে সাক্ষ্য রয়েছে। ইবনে বতুতার বর্ণনায় জানা যায় তিনি চৌদ্দ শতকের মাঝামাঝি সময়ে যখন কিছুদিন সোনারগাঁওয়ে অবস্থান গ্রহণ করেন তখন সেখানকার বাজারে দাসদাসী কেনাবেচা করা হতো। ইবনে বতুতা নিজেও একটি বালিকা ক্রয় করেছিলেন। চকবাজার বরাবর বুড়িগঙ্গা পাড়ি দিলে কেরানীগঞ্জে একটি বাজার আছে। নাম গোলাম বাজার। কে জানে হয়তো এককালে দাস বিক্রির স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে।
ইংরেজ যুগে চকবাজারে হিন্দু-মুসলমান ও মাড়োয়ারি সম্প্রদায়ের অনেকেরই দোকান ছিল। ‘ঢাকা পাচাস বারাস পহলে’ নামের একটি গ্রন্থ লিখেছিলেন হাকিম হাবিবুর রহমান। এই গ্রন্থের বক্তব্য থেকে জানা যায় লখনৌ থেকে মাদার বখশ ও আলাউদ্দিন নামে দুই মিষ্টিওয়ালা এসে চকবাজারে দোকান খুলে বসেন। অনুমান করা হয় আলাউদ্দিন ১৮৮৫ হতে ১৮৯০ সালের মধ্যে লখনৌ থেকে ঢাকায় এসেছিলেন। আজকের আলাউদ্দিনের মিষ্টি এরই ক্রমবিকাশ। বিশ শতকের গোড়ার দিকে চকবাজারে আলাউদ্দিনের মিষ্টির দোকানে মিষ্টির পাশাপাশি বাকরখানিও তৈরি করা হতো। জনপ্রিয় ছিল এদের তৈরি নানরুটি।
একটি বাজার প্রাথমিকভাবে বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে বিকাশ লাভ করে। কালক্রমে এই বাজারকে ঘিরে সামাজিক ও প্রশাসনিক গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। মোগল যুগ থেকে একটি আধুনিক নগর হিসেবে ঢাকার বিকাশ বেশ গতি পেয়েছিল। ইংরেজ শাসনযুগেও তা অব্যাহত থাকে। এই বিকাশ পর্বে অনেক বেশি উল্লেখ করার মতো হাট-বাজার বা গঞ্জ গড়ে ওঠে।
একই সাথে চকবাজারকে কেন্দ্র করে প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানও স্থাপিত হয়।
বসতির প্রয়োজনে প্রধান সড়কের পর বাড়িঘর বা পাড়া-মহল্লায় যাওয়ার জন্য অনেক অলিগলি তৈরি হয়। বলা হয় ঢাকায় বাজার আর গলির ছড়াছড়ি। কথায় আছে, ঢাকা হচ্ছে ‘বায়ান্ন বাজার আর তেপ্পান্ন গলির শহর’। অনেকের ধারণা চকবাজারের আশপাশের গলি দেখে এমন প্রবাদের জন্ম হয়েছে। চকবাজারকে ঘিরেই মোগল ও ইংরেজ যুগে মিটফোর্ড রোড, ইসলামপুর, বাংলাবাজার, নবাবপুর, বংশাল এসব এলাকায় বসতি গড়ে উঠতে থাকে। এসব বসতির কারণে চকবাজার ঘিরে সামাজিক ক্রিয়াকর্মের খোঁজও পাওয়া যায়। এখনো পুরান ঢাকায় রমজান মাসে কাসিদা গাওয়ার প্রচলন আছে। শেষ রাতে সেহরি খাওয়ার জন্য মহল্লাবাসীকে জাগাতে কাসিদা নামে এক ধরনের গান গাওয়া হয়। সমাজে কাসিদা শিল্পীদের সম্মান ছিল। ঈদের দিন চকবাজারে আনুষ্ঠানিকভাবে কাসিদা শিল্পীদের পুরস্কৃত করা হতো।
বিশ শতকের শরুর দিকে চকবাজার থেকে ঈদ মিছিলের যাত্রা শুরু হয়। মহররম মিছিল হোসেনী দালান থেকে যাত্রা করলেও চকবাজার একপাক ঘুরে আসত। এভাবে চকবাজারের সামাজিক গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। ধীরে ধীরে বিয়ে অনুষ্ঠান ঘিরে একটি রেওয়াজ চালু হয়। নববিবাহিত বর-কনেকে টমটম নামে একটি ঘোড়ার গাড়িতে বসানো হতো। রঙিন কাগজ ফুল ইত্যাদি দিয়ে সাজানো হতো টমটম। পেছনে থাকত বরযাত্রীদের আরো কটি ঘোড়ার গাড়ি। এই গাড়িকে ঘিরে যুক্ত হতো মহল্লার ছেলেমেয়েদের মিছিল। কিশোর তরুণদেরই সমাগম হতো বেশি। এই সুসজ্জিত গাড়ি নিয়ে চকবাজার অন্তত একপাক ঘুরে আসাটা ছিল সামাজিক রেওয়াজ। রাস্তার দুই পাশে মানুষ দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য উপভোগ করত।
বিয়ের কেনাকাটার জন্য সে যুগে চকবাজার ছিল অনবদ্য। শাড়ি-গয়না থেকে শুরু করে বরের পোশাক এবং গায়ে হলুদের যাবতীয় দ্রব্যাদি পাওয়া যেত চকবাজারে। বিশেষ করে হিন্দু বিয়েতে কন্যা সাজাতে ফুল ছিল অপরিহার্য। বাসরঘর সাজাতেও অনেকে ফুল ব্যবহার করত। এ কালের মতো তখন বাণিজ্যিকভাবে তেমন ফুল চাষ হতো না। তাই যত্রতত্র ফুলের দোকানও ছিল না। ফুল কিনতে পাওয়া যেত শুধু চকবাজারে।
এক সময় চকবাজারকে কেন্দ্র করে প্রশাসনিক গুরুত্ব বৃদ্ধি পাওয়ার কথা জানা যায়। চকবাজারের কাছেই বর্তমানে কেন্দ্রীয় কারাগার অবস্থিত। মোগলপূর্ব যুগে এখানে ‘ঢাকা দুর্গ’ নামে একটি দুর্গ ছিল। ১৭৭৩ সালে এই দুর্গকে কারাগারে রূপান্তরের আগে এখানে সরকারিভাবে টাকশাল স্থাপন করা হয়। ১৮১১ সালে জেলখানার পাশে তৈরি করা হয়েছিল পাগলা গারদ। কোনো কোনো সূত্রে পাওয়া যায় জেলখানার কাছাকাছি চকবাজার সংলগ্ন একটি খোলা চত্বরে ফাঁসির মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল। দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামিদের এখানে ফাঁসি দেওয়া হতো। বিশ শতকের শুরুর দিকে চকবাজারের বাজার এলাকা সম্প্রসারিত হলে ফাঁসির মঞ্চটি সরিয়ে ফেলা হয়।
চকবাজারের সামাজিক ও প্রশাসনিক গুরুত্ব থাকায়ই সম্ভবত এক সময় প্রদর্শনের উদ্দেশে মোগল যুগের দুটি কামান চকবাজারের মধ্যস্থলে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এর একটির নাম ছিল ‘বিবি মরিয়ম’। অনুমান করা হয় অন্য কামানটি এক সময় বুড়িগঙ্গায় তলিয়ে যায়। পরবর্তী সময় কামান ‘বিবি মরিয়ম’ গুলিস্তানে স্থাপন করা হয়। বর্তমানে তা ওসমানি উদ্যানের ফটকের কাছে স্থাপিত।