ঢাকার কথা ১০
বারভুঁইয়ার যুগে ঢাকা
১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে মোগল সম্রাট বাবর দিল্লির সুলতানি শাসনের অবসান ঘটিয়ে মোগল আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বাবরের পর সম্রাট হুমায়ুন ভারত সম্রাট হয়ে বাংলা অধিকারের জন্য সসৈন্যে অগ্রসর হন। ১৫৩৮ সালের শেষ দিকে গৌড় অধিকার করে ছয় মাস উত্তর বাংলা নিজের অধিকারে রেখেছিলেন। কিন্তু বিহারের সামন্ত শাসক শেরখান সুর তাঁকে আক্রমণ করে বাংলা থেকে বিতাড়িত করেন। শুধু বাংলা নয় পিছু ধাওয়া করে শের খান হুমায়ুনকে ভারত থেকেও হটিয়ে দেন। এবার দিল্লির শূন্য সিংহাসনে বসেন আফগান নেতা শেরখান। নিজেকে পরিচিত করেন শেরশাহ নামে। এভাবে ভারতে মোগল সাম্রাজ্যের সাময়িক বিরতি ঘটিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় আফগান শাসন। একই সাথে শেরশাহের বংশধর আফগানরা বাংলায় স্বাধীন সুলতানি রাজ্য গড়ে তোলেন।
স্বল্পকালীন আফগান শাসনের অবসান ঘটিয়ে হুমায়ুন ভারতে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন মোগল শাসন। হুমায়ুনের মৃত্যুর পর তরুণ সম্রাট আকবর মোগল সিংহাসনে বসে বাংলা অভিযানের আয়োজন করেন। আকবরের জীবদ্দশায় উত্তর ও পশ্চিম বাংলা অধিকৃত হলেও পূর্ববাংলা মোগল অধিকারের বাইরে ছিল। এ সময় পূর্ববাংলার বড় জমিদাররা একজোট হয়ে মোগলদের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। ইতিহাসে এই জমিদাররা বারভুঁইয়া নামে পরিচিত। বারভুঁইয়ারা বাংলার স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখতে পেরেছিলেন ১৬১০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। জমিদার ঈশা খাঁর নেতৃত্ব সংগঠিত ছিলেন বারভুঁইয়ারা।
বারভুঁইয়াদের সময়ে ঢাকার অবস্থা কেমন ছিল তা সরাসরি ইতিহাসের সূত্রে স্পষ্ট করা যায় না। তবে প্রত্নতাত্ত্বিক সূত্র এবং বাংলায় মোগল ইতিহাসের আকর গ্রন্থ মির্জা নাথানের লেখা ‘বাহারিস্তান-ই-গায়েবী’ থেকে একটি চিত্র অঙ্কন করা সম্ভব। একই সঙ্গে কয়েকটি ঐতিহাসিক যুক্তিও গ্রহণ করা যেতে পারে। সম্রাট আকবরের সময় ঢাকা ঈশা খাঁ মসনদ-ই-আলার নিয়ন্ত্রণে ছিল। ঈশা খাঁর রাজধানী কেন্দ্র ছিল বৃহত্তর সোনারগাঁওয়ের কাতরাবোতে। সোনারগাঁওয়ের প্রবেশ মুখে বর্তমান ঢাকা চট্টগ্রাম হাইওয়েতে কাঁচপুর ব্রিজ থেকে আনুমানিক তিন কিলোমিটার দক্ষিণে দেওয়ানবাগের অবস্থান। এই দেওয়ানবাগ ছিল ঈশা খাঁর খাজনা আদায়কারী প্রশাসন কেন্দ্র। দেওয়ানবাগে ঈশা খাঁর নামাঙ্কিত কামান পাওয়া গেছে। সোনারগাঁওসহ বৃহত্তর ঢাকায় মোগল আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য তিনি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করেছিলেন। বাংলা অক্ষরে কামান লিপি নিম্নরূপে লেখা ছিল
'সরকার শ্রীযুত ইছা খাঁ
ন মসনদালি সন হিজরি
১০০২'
এভাবে লিপি সাক্ষ্যে নিশ্চিত হওয়া যায় ১৫৯৩-৯৪ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা অঞ্চল ঈশা খাঁর নিয়ন্ত্রণাধীনে ছিল।
মোগল সুবাদার ইসলাম খানের ঢাকা দখলের প্রধান কারণ বারভুঁইয়াদের চূড়ান্তভাবে পরাজিত করা। মোগলরা উত্তর থেকে পূর্ববাংলার দিকে অগ্রসর হয়েছিল। পথে অনেক জমিদার মোগল বশ্যতা স্বীকার করে। বারভুঁইয়াদের শেষ ঘাঁটি শীতলক্ষ্যা নদীতে। ঈশা খাঁর মৃত্যুর পর এ সময় বারভুঁইয়ারা নেতা মেনেছিলেন তাঁর পুত্র মুসা খাঁকে। পিতার মতো কাতরাবোই ছিল মুসা খাঁর রাজধানী কেন্দ্র। বর্তমান নারায়ণগঞ্জ শহরে অবস্থিত মোগল জলদুর্গ হাজীগঞ্জ দুর্গ শীতলক্ষ্যার তীরে অবস্থিত। দুর্গটি তৈরি হয়েছিল ঢাকায় মোগল আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পরে। হাজিগঞ্জ দুর্গ বরাবর শীতলক্ষ্যার অপর পাড়ের এলাকাটির নাম নবীগঞ্জ। এখানেই ছিল মুসাখানের সামরিক ছাউনি। বারভুঁইয়াদের রণতরী ছিল শীতলক্ষ্যা নদীতে। এ কারণেই বারভুঁইয়াদের শেষ শক্তিতে আঘাত করার জন্য এর কাছাকাছি অঞ্চল ঢাকাকে বেছে নিয়েছিলেন মোগল সুবাদার।
মোগল সুবাদারদের লক্ষ্য ছিল শীতলক্ষ্যা নদীতে অবস্থিত বারভুঁইয়াদের শেষ নৌঘাঁটি ধ্বংস করে পূর্ববাংলায় মোগল আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। নারায়ণগঞ্জের কাছে শীতলক্ষ্যা নদীতে আক্রমণ পরিচালনার জন্য কাছাকাছি কোনো অঞ্চলে সুবাদারের শিবির স্থাপন করা ছিল জরুরি। এ কারণেই সুবাদার ইসলাম খাঁন ঢাকাকে বেছে নেন। মোগল আগমন-পূর্ব সময় থেকে ঢাকায় একটি নাগরিক জীবন প্রতিষ্ঠিত থাকায় সুবাদার ঢাকাকে নির্বাচন করেন। শিবির স্থাপনের জন্য কৌশলগত দিক থেকে শীতলক্ষ্যা নদীতে নৌ আক্রমণের জন্য উপযুক্ত বিবেচনা করা হয়েছিল ঢাকাকে। সাধারণত মোগল বহরের আঙ্গিক খুব বিশাল হয়ে থাকে। সুবাদার, সভাসদ, সৈন্যবাহিনী, নানা পদবির কর্মচারী, লটবহর, অস্ত্রশস্ত্র, হাতি, ঘোড়া ইত্যাদি থাকে মোগল বহরে। এসব কারণে নাগরিক সুবিধা সম্পন্ন এলাকাকে গুরুত্ব দেওয়া হয় শিবির স্থাপনে।
সুবাদার ইসলাম খান ঢাকায় প্রবেশের আগেই ঢাকা সম্পর্কে অবহিত হয়েছিলেন। ‘বাহারিস্তান-ই-গাইবী’ গ্রন্থে মির্জা নাথান উল্লেখ করেন, মোগল বহর উত্তর বাংলার পথে অগ্রসর হয়েছিলেন। পথিমধ্যে বগুড়ার শেরপুর মোর্চাতে যাত্রা বিরতি করেন। এখান থেকে তাঁর নৌবহর সুসংগঠিত করে ঢাকার দিকে অগ্রসর হন। ইসলাম খাঁর নেতৃত্বে নৌ ও গোলন্দাজ বাহিনী ইছামতি নদী দিয়ে এগিয়ে চলে। বিশাল পরিকল্পনায় সাজানো নৌবহর দেখে অনুমান করা যায় ঢাকায় তখন বারভুঁইয়াদের শক্ত ঘাঁটি ছিল। এই শহরকে অধিকার করার জন্য তেমনভাবেই প্রস্তুতি নেন সুবাদার।
যুদ্ধের বর্ণনাটি এমন ছিল, মোগল নৌবহর শ্রীপুর ও বিক্রমপুরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ইতিমাম খাঁর (মির্জা নাথানের পিতা) স্থল বাহিনী নৌবহরকে অনুসরণ করে। ইতিমাম খাঁকে নৌ ও গোলন্দাজ বাহিনীর কেন্দ্রস্থল থেকে সতর্ক অবস্থায় এগিয়ে যেতে বলা হয়। মির্জা নাথানকে থাকতে বলা হয় অগ্রগামী রিজার্ভ দলের পরিচালনায়। এসব বহরের ডানে ও বামে রাখা হয়েছিল ওমরাহদের নৌবহর। এই অভিযাত্রায় পাথরঘাটা বলে একটি অঞ্চলের কথা বলা হয়েছে। সম্ভবত এখানে বারোভুঁইয়াদের নৌবহরের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। মির্জা নাথান তাঁর বর্ণনায় ‘শত্রুপক্ষের নৌকা’ বলেছেন। নাথান লিখেন, “...পরদিন ভোরে পূর্ব নির্দেশ মতো রণবেশে সজ্জিত বড় নৌবহর নিয়ে শাহী কর্মচারীরা স্থল ও জল পথে পাথরঘাটার (বিক্রমপুর অঞ্চলে) মোহনার উদ্দেশে রওনা হলো। অগ্রবর্তী দল হিসেবে পাঠানো কয়েকটি নৌকা পাথরঘাটার নিকট শত্রু পক্ষের নৌকার মুখোমুখি হয়। শত্রু পক্ষের ১৫টি নৌকা এবং শাহী দলের মাত্র সাতটি নৌকা থাকার পরও শাহী নৌকা দেখা মাত্র তারা পালিয়ে যায়। সাতটি নৌকা দুই ক্রোশ পর্যন্ত তাদের অনুসরণ করে। কিন্তু নৌকাগুলো অনেক দূরে চলে যাওয়ায় তারা তাদের ধরতে পারেনি। এরপর নৌ ও স্থল বাহিনী পাথরঘাটায় তাদের তাঁবু ফেলে। এই সময়েই পাথরঘাটায় সেনা নায়কদের কাছে ইসলাম খাঁর পত্র পৌঁছে। এতে জানা যায় ততক্ষণে ইসলাম খাঁ ঢাকায় পৌঁছে গেছেন। তিনি নানা অঞ্চলে অবস্থান নেওয়া নৌ ও স্থল বাহিনীকে ঢাকায় চলে আসার নির্দেশ দেন।”
মোগল আগমন-পূর্ব ঢাকার নাগরিক জীবন সম্পর্কে মির্জা নাথানের ভাষ্য থেকে জানা যায়- বর্তমান কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকায় এ সময় একটি দুর্গ ছিল। এই দুর্গ ছিল আফগান বা স্থানীয় জমিদারদের গড়া। ‘ঢাকা দুর্গ’ নামে পরিচিত এই দুর্গ সংস্কার করে সুবাদার ইসলাম খানের আবাস স্থল বানানো হয়।
ঢাকা অধিকারের পর ইতিমাম খাঁ ও মির্জা নাথান ডেমরা খালের মোহনার দুই পাশে অবস্থিত বেগ মুরাদ খানের দুর্গ দুটির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই বর্ণনায় ঢাকার অভ্যন্তরে ঢাকা দুর্গ এবং উপকণ্ঠ ডেমরায় দুটো দুর্গের অবস্থান বারোভুঁইয়াদের সময় ঢাকার গুরুত্ব নির্দেশ করে।